১৬ গ্রেডের বেতন: মানবেতর দিন চলছে ইবতেদায়ির শিক্ষকদের

দেশের প্রতিটি খাতে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে সব শ্রেণি-পেশায় এবং জনজীবনে। কিন্তু আনুপাতিক উন্নয়নের ধারায় পিছিয়ে আছে কিছু খাত, জনগোষ্ঠী ও পেশাজীবী। এর মধ্যে বেসরকারি শিক্ষা তথা এমপিও, নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্যতম। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পেশাজীবীরা অন্যান্য খাতের পেশাজীবীদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে।

একটি দেশ উন্নয়নের পথে হাঁটলে ক্রমে তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, গাড়ি-বাড়িভাড়া, দ্রব্যমূল্যসহ সব ক্ষেত্রেই কিছুটা মূল্যবৃদ্ধি হবে, এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু সর্বশেষ পে স্কেল ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১৫ সালে, প্রায় ৮ বছর আগে, তখন সেটা ছিল সরকারের একটা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। সরকারি ট্রেজার থেকে বেতনপ্রাপ্ত পেশাজীবীদের জন্য সেটা ছিল শ্রেষ্ঠ একটা পাওয়া। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে সেই পে স্কেল এখন নিতান্তই সামান্য বিবেচিত হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা) পেশাজীবীদের জন্য বর্তমান জীবনযাত্রার সঙ্গে তাল মেলানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা সেক্টরের চাকরিজীবীরা যেখানে মূল বেতন স্কেলের ৪৫ শতাংশ বাড়িভাড়া, পূর্ণ উৎসব ভাতা, ১ হাজার ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতাসহ দ্রুত প্রমোশন, বদলি, পেনশন, অবসরকালীন নিরাপত্তা ভাতা ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছেন, সেখানে বেসরকারি শিক্ষা খাতটি চরমভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। সমবেতন গ্রেড হলেও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় যেন এই সেক্টর বিমাতার সন্তান। মূল বেতনের সঙ্গে মাসে বাড়িভাড়া মাত্র ১০০০ টাকা এবং চিকিৎসা ভাতা মাত্র ৫০০ টাকা যুক্ত হয়। উৎসব (ঈদ) ভাতা মাত্র ২৫ শতাংশ আর বৈশাখী ভাতা নামমাত্র। নেই কোনো বদলি, পদোন্নতির সুযোগও সীমিত।

বর্তমানে এনটিআরসিএর জাতীয় মেধাতালিকার ভিত্তিতে শিক্ষকেরা নিজ বাড়ি থেকে ক্ষেত্রবিশেষে ৪০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে চাকরি পাচ্ছেন। অঞ্চলভেদে বাড়িভাড়া কমপক্ষে ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা। ঈদে ১১ গ্রেডের (স্কেল-১২,৫০০) সহকারী শিক্ষকেরা উৎসব ভাতা পান মাত্র ৩ হাজার ১২৫ টাকা, আরও দুঃখজনক বিষয় হলো এখনো মাদ্রাসার ইবতেদায়ি শিক্ষক, মৌলভি বা কারিদের বেতন গ্রেড ১৬, বেতন স্কেল ৯৩০০। শিক্ষকের বেতন গ্রেড ১৬ বা স্কেল ৯৩০০ টাকা হলে কীভাবে দিনাতিপাত করতে পারেন? তাঁদের মনোযোগ শিক্ষাবিস্তারে থাকবে, নাকি জীবন–জীবিকার চিন্তায় তাঁদের দিন কাটবে? চার থেকে পাঁচজন সদস্যের পরিবারে মাসিক বেতন ৯ হাজার ৩০০ বা ১২ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে কীভাবে চলবে?

আরও পড়ুন

এবার আসা যাক বর্তমান দ্রব্যের বাজারমূল্য এবং গাড়িভাড়ায়। চার থেকে ছয়জন সদস্যের (স্ত্রী, ২ সন্তান, মা-বাবা) একটা পরিবারের ঈদের পোশাক কিনতে ৫ থেকে ৭ সাত হাজার টাকা লাগে। ১০ হাজার টাকার কম কোরবানির পশু কেনাই সম্ভব নয়। কয়েক বছরে গাড়িভাড়া বেড়েছে ২ থেকে ৩ গুণ। চাল, ডাল, তেলের দামও বেড়েছে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। শাকসবজি, মাছ-মাংসের দামও বেড়েছে ২ থেকে ৩ গুণ।
সর্বশেষ পে স্কেলে মহার্ঘ ভাতাও বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের এমন ঊর্ধ্বমুখী অবস্থায় মহার্ঘ ভাতাকে আবার একবার স্মরণ না করে উপায় নেই। একজন শিক্ষকের মাসিক বেতনের সবটুকুই যদি জীবনধারণে ব্যয় করতে হয়, তাহলে তাঁর এবং তাঁর পরিবারের ভবিষ্যৎ আর্থিক নিরাপত্তা কোথায়? অন্যদিকে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অবস্থা আরও মানবেতর। গ্রেডভেদে তাঁদের বেতন ৮ হাজার ২৫০ থেকে ৯ হাজার ৩০০ টাকা।

এ অবস্থায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পেশাজীবীদের একটা বড় অংশ সমগ্র শিক্ষা খাত জাতীয়করণের পক্ষে সমর্থন সমর্থন দিচ্ছেন। কিন্তু জাতীয়করণের বিষয়টি সরকারের একটা বৃহৎ ও জটিল সিদ্ধান্তের ব্যাপার। জাতীয়করণের সঙ্গে সরকারের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের সমন্বয়সাধন প্রয়োজন; পাশাপাশি এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কিছু পারিপার্শ্বিক নিয়ামক ও সক্ষমতার ওপরও নির্ভরশীল। তাই খুব দ্রুত, একই সঙ্গে সমগ্র শিক্ষা খাত জাতীয়করণ করা সম্ভব নয়। তাই অনুমেয়, জাতীয়করণের বিষয়টি সরকার ধারাবাহিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এগিয়ে নিতে থাকবে।

এখন প্রশ্ন, তাহলে আমরা কি শুধু জাতীয়করণের দাবি নিয়েই থাকব? অনেকে মনে করে থাকেন জাতীয়করণই এই খাতের সব বৈষম্য দূর করতে সক্ষম। হ্যাঁ, হয়তো সক্ষম বা হয়তো না। কিন্তু যত দিন জাতীয়করণ হচ্ছে না, তত দিন কি এ রকমই চলতে থাকবে? নিশ্চয় না।

বর্তমান সরকার শিক্ষাবান্ধব। এর আগে ঐতিহাসিক পে স্কেল কার্যকর হয়েছে এই সরকারের হাত ধরেই। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রতিষ্ঠানে জনবল বৃদ্ধিসহ একাধিক যুগান্তকারী বিষয় বাস্তবায়ন করা হয়েছে এই সরকারের আমলেই। তাই আশা করি, পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণের বিষয়টি চলমান থাকবে।
সুতরাং এই ধারাবাহিক জাতীয়করণের প্রক্রিয়ার পাশাপাশি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বেতন-ভাতা-বোনাস ইত্যাদি বিষয় সমন্বয় করা জরুরি। একদিকে বেতন বৃদ্ধি করে গ্রেডভিত্তিক বেতন–বৈষম্য দূর করা যেমন প্রয়োজন, তেমন প্রয়োজন বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও উৎসব ভাতার সমন্বয়সাধন। পাশাপাশি প্রয়োজন বদলি-পদোন্নতিসহ আগের মহার্ঘ ভাতা পুনরায় বহাল রাখা।
তাই জাতীয়করণের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পণের এ শুভ লগ্নে ঊর্ধ্বমুখী বাজারমূল্য বিবেচনায় মহার্ঘ ভাতার সুবিধা পুনর্বহাল করে বেতন-ভাতা-বোনাস বৃদ্ধি ও সমন্বয়ের কোনো বিকল্প নেই।

মো. আবু বকর সিদ্দিক
ইবতেদায়ি শিক্ষক
আওতাপাড়া আবু বকরিয়া (এবিসি) আলিম মাদ্রাসা, ঈশ্বরদী, পাবনা।

আরও পড়ুন