দায়হীনতার দায় কার?

বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ড

ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর। দুই কোটির বেশি মানুষের বাস এই শহরে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ইমারত তৈরি হচ্ছে সময়ের প্রয়োজনে। অনেক ভবনে পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা, ভূমিকম্প-পরবর্তী নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই। নামা-ওঠার সিঁড়ি সংকীর্ণ। এসব ভবনে কোনোভাবে আগুন লেগে গেলে ভেতরে অবস্থানকারী মানুষের বাঁচার কোনো উপায় নেই।

ঠিক তেমনটাই ঘটেছে। কয়েক দিন আগে রাজধানীর বেইলি রোডে অনেকগুলো রেস্টুরেন্টের একটি ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সর্বশেষ তথ্যমতে ৪৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন।

অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঘটনা এবারই প্রথম নয়। নিমতলীর রাসায়নিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ড, বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডসহ বহু ঘটনা রয়েছে। প্রতিটি ঘটনারই পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভবনগুলো বসবাস এবং অন্য কাজের অযোগ্য ছিল।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে বঙ্গবাজার অগ্নিকাণ্ডের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে তারা নোটিশ দিয়েছিল; কিন্তু মার্কেট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি। পরবর্তী ঘটনা তো সবারই জানা।

কিছু তদন্ত হয়। ওই পর্যন্তই শেষ। বিচার পর্যন্ত পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে যায়।

ভবনে আগুন লাগলে দেবালয় রক্ষা পায় না। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনেকের মধ্যে দ্বিমত থাকলেও দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এটা সত্য। কিন্তু এ ধরনের দুর্ঘটনায় যদি শত শত পরিবার পথে বসে যায়, প্রিয়জন হারানোর ব্যথায় কাতর হয়, তাহলে সেই উন্নয়ন ভোগ কারা করবে। যাদের জন্য এত আয়োজন, তারাই যদি না থাকে, তাহলে সবকিছুই তো বৃথা প্রতিপন্ন হয়।

বর্তমান মানুষের অকালমৃত্যুর প্রধান দুটি কারণ হলো অগ্নিকাণ্ড ও সড়ক দুর্ঘটনা। সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা যাওয়ার পর দেখা যায়, সেই গাড়ি হয় হেলপার চালাচ্ছিলেন, না হয় গাড়িটি ফিটনেসবিহীন ছিল। কয়েক মাস আগে মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে বাস দুর্ঘটনায় ১৯ জন নিহত হন। পরবর্তী সময়ে জানা যায়, বাসটি ফিটনেসবিহীন ছিল। এমন হাজারো ফিটনেসবিহীন বাস চলছে, কিন্তু এটা জানা যায় কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটার পর।

সংবাদমাধ্যমে জেনেছি, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের  অগ্নিকাণ্ড ও দুর্ঘটনাসংক্রান্ত কার্যক্রমের ২০২২ ও ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, সারা দেশে এই দুই বছরে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৬৩টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আগের ১৪ মাস ১০ দিনে সারা দেশে অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছেন ১৪৫ জন। ২০২২ সালে সারা দেশে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এসব ঘটনায় ৩৪২ কোটি টাকার বেশি সম্পদ পুড়েছে।

এর আগের বছর ২১ হাজার ৬০১টি অগ্নিকাণ্ডে ২১৮ কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে যায়। আর ২০২০ সালে সারা দেশে ২১ হাজার ৭৩টি আগুনের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২৪৬ কোটি টাকা।

সব থেকে বড় বিষয় হচ্ছে, একটা অপরাধ সংঘটিত হলে তার যদি সুষ্ঠু বিচার হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে অপরাধীরা বা অন্য কেউ সেই কাজ করার সাহস পান না। ১১ বছর আগের ঢাকার নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। একটা জিডি করা হয়েছিল, যার তদন্ত প্রতিবেদন আজ পর্যন্ত আদালতে দাখিল হয়নি বলে সংবাদমাধ্যমে জেনেছি।

২০১২ সালের আশুলিয়ায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১১২ জনের মৃত্যু হয়। সেই ঘটনায় মামলা হলেও এখনো বিচারকাজ শেষ হয়নি। এরপর ২০১৯ সালের চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও বিভিন্ন সংস্থার হিসাবমতে, দুই দশকে বাংলাদেশে শিল্পকারখানায় ২৬টির বেশি দুর্ঘটনায় দুই হাজারের মতো শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। হতাহতের দিক থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ ১৫টি অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে মাত্র ৩টি ঘটনার পর মামলা হয়েছে। দোষীরা সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন। আর নিহত ও আহত ব্যক্তিদের জন্য যে সাহায্যের ঘোষণা করা হয়, তা-ও সব সময় স্বজনেরা পান না। পেলেও তার জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়।

২০১০ সালে নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গঠিত হওয়া তদন্ত কমিটি ১৭টি সুপারিশ পেশ করেছিল। কিন্তু যেখানে জিডির তদন্তই এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি, সেখানে সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন অসম্ভবই বলা চলে। সেই ১৭টি সুপারিশ যদি বাস্তবায়িত হতো, তাহলে হয়তো পরবর্তী সময়ে চকবাজার, আশুলিয়ায় ঘটা অগ্নিকাণ্ডগুলো ঘটত না। আর ঘটলেও ক্ষয়ক্ষতি কম হতো এবং প্রাণহানি এড়ানো যেত।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পাঁচ বছর আগের তথ্যমতে, ঢাকা শহরের ভবনের সংখ্যা ২২ লাখ। এখন আরও বেশি। সে সময় অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ছিল ৩২১, এখন যা ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু সেই অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো সিলগালা করে বন্ধ করে দেওয়া হয়নি। সেখানে মানুষ এখনো বসবাস করছেন, কারখানা চলছে। ফলে কিছুদিন পরপর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এখনো যদি সরকার এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে সাধারণ মানুষের মৃত্যুর লাইন দীর্ঘায়িত হবে। রাজউকের আরেকটি জরিপে বলা হয়েছে, ৭৫ শতাংশ ভবনই কোনো না কোনোভাবে নিয়ম লঙ্ঘন করেছে।

অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রচলিত আইনের ব্যবহার করতে হবে। আবাসিক ভবনে গুদাম বা কারখানা করা যাবে না। ভবনে অগ্নি প্রতিরোধের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ ঘটাতে হবে। নীতিমালা মেনে ভবন নির্মাণ হচ্ছে কি না, তা কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কারণ, সামান্য অবহেলা হাজারো মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

সুকান্ত দাস

শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।