শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন পেলে কৃষকেরাও বাঁচবেন

যাঁরা ১৮ কোটি মানুষের অন্ন জোগান, তাঁদের পেটেই থাকে ক্ষুধা—বিষয়টি একপক্ষীয় এক করুণ কাহিনি। উচ্চশিক্ষিত সমাজ যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়, তাহলে মেরুদণ্ড রক্ষাকারী মানুষটি হচ্ছেন কৃষক। কেননা, আমরা উচ্চশিক্ষা বিক্রি করে ব্যাংক ভরে ফেলতে পারব ঠিকই, কিন্তু ওই টাকা দিয়ে যদি খাবার কিনতে না পারি, তাহলে ব্যাংকের টাকা ব্যাংকেই থেকে যাবে।

দেশ যদি নিজেই কিছু না করতে পারল, তাহলে আমদানি পণ্যের ওপর কত দিন চলবে? শুধু উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশের উন্নতির ভরসা করা হাস্যকর। ব্যক্তি যতই শিক্ষিত হোক তার প্রধান চাহিদা খাদ্য। আর সেই খাদ্যের জোগানদাতাই যদি অবহেলার পাত্র হয়ে যায়, তাহলে ধরে নেওয়া যায় শিক্ষার উপযুক্ততা নেই। কৃষক যদি খাদ্য জোগানে অস্বীকৃতি জানান, তবে মানুষ না খেয়ে মারা যাবে। শিক্ষিত সমাজের তখন হা করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া দ্বিতীয় উপায় থাকবে না। কৃষক এখন নিরুপায়। তাঁদের থেকে ফসল ফলিয়ে নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজার গরম রাখেন।

বিবিএসের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রধানত কৃষি, শিল্প, উৎপাদন ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি চলতি অর্থবছরের প্রাক্কলনে কমে যাওয়ার প্রভাব দেখা গেছে সার্বিক প্রবৃদ্ধির সাময়িক হিসাবে। চলতি অর্থবছর কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে ২ দশমিক ৬১ শতাংশ, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৩ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাজেট দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাজেট বাস্তবায়নে। আগামী অর্থবছরে শস্য কৃষি খাতের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৫ হাজার ১১৪ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। বাকি ২ দশমিক ৪১ শতাংশ মৎস্য ও পশুসম্পদ, বন ও পরিবেশ, ভূমি ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়গুলোর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এটা খুবই অপ্রতুল।

দিনের পর দিন বাজেটে বৃহত্তর কৃষি খাতের হিস্যা হ্রাস পাচ্ছে। ২০১১-১২ সালে বৃহত্তর কৃষি খাতের হিস্যা ছিল মোট বাজেটের ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে তা ৬ দশমিক ২ শতাংশ হ্রাস পায়। এবার তা নেমে এসেছে ৫ দশমিক ৭ শতাংশে। এর কারণ, যে হারে মোট বাজেট বাড়ছে, সে হারে কৃষি খাতের বাজেট বাড়ছে না। এবার মূল বাজেট বেড়েছে ১২ দশমিক ৩৫ শতাংশ, কৃষি বাজেট বেড়েছে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। জিডিপিতে বৃহত্তর কৃষি খাতের শরিকানা এখনো প্রায় ১২ শতাংশ। খাদ্যনিরাপত্তার জন্য আমরা পুরোপুরি নির্ভরশীল কৃষি খাতের ওপর। সে কারণে মোট বাজেটে কৃষি খাতের শরিকানা ন্যূনপক্ষে এর মোট অবদানের সমানুপাতিক হওয়া উচিত।

দেশের বিশালসংখ্যক মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষি। এক স্থানীয় কৃষকের মতে, এক বিঘা জমির পাট বাজারজাতকরণের পর নিজের কিছুই থাকে না। হাজার টাকার বিনিময়েও জোগানদার পাওয়া যাচ্ছে না। বীজ বপনের আগের প্রস্তুতি অর্থাৎ চাষযোগ্য জমি তৈরি থেকে শুরু করে ফসলকে বাজারে ওঠানো পর্যন্ত একজন কৃষক শান্তির ঘুম বিছানায় ঘুমাতে পারেন না। বেশির ভাগ সময় মাঠেই কাটিয়ে দিতে হয়। তা ছাড়া বেশির ভাগ কৃষক অন্যের জমি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চুক্তি নিয়ে চাষ করে ফসল ফলান। এই যদি হয় কৃষকদের অবস্থা, তাহলে কীভাবে উন্নতি হবে কৃষি খাত?

এরূপ দুর্দশা সমাধানের বেহাল অবস্থায় বাধ্য হয়ে বিদেশমুখী হচ্ছেন বেশির ভাগ কৃষক। ফলে ফাঁকা পড়ে থাকতে দেখা যায় অনেক জমি। ফসল মৌসুমে সাধারণত দাম কম থাকে, কিন্তু দরিদ্র কৃষকদের ফসলই একমাত্র ভরসা। এখন সেই ফসল বিক্রির মাধ্যমে কৃষক কীভাবে তাঁর খরচ তুলে নিতে পারবেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে। বিনা সুদে ঋণ ও কম মূল্যে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা পেলেই কৃষকের মুখে হাসির সুখবার্তা ফুটে উঠবে। পাশাপাশি ফসলের বৈচিত্র্যতা আনতে হবে। ফলে কৃষকের মনের আনন্দ ফসলের খেত ভরে প্রবাহিত হবে।

এস এম জসিম
শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।