চলনবিলে কৃষকছাউনি নির্মাণ ও বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করা হোক

চলনবিল হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল এবং সমৃদ্ধ জলাভূমি। চলনবিল নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলাজুড়ে বিস্তৃত। চলনবিলের মধ্য দিয়ে ৪৭টি নদী ও অন্যান্য জলপথ প্রবাহিত হয়। চলনবিলের আয়তন ছিল প্রায় ১ হাজার ৮৮ বর্গকিলোমিটার। বর্তমানে চলনবিলের আয়তন অনেক কমেছে।

খাদ্যশস্য ভান্ডারখ্যাত চলনবিলকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো উপজেলার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। কৃষিকাজের পাশাপাশি মৎস্য চাষ ও গবাদিপশুর খামার করে অনেকে স্বাবলম্বী হয়েছেন। অনেকে আবার বিলের উন্মুক্ত জলাশয়ে হাঁস পালন করছেন। প্রতিদিন চলনবিল অঞ্চলের হাটবাজার থেকে ক্রেতারা শাকসবজি কিনে পাবনা, রাজশাহী, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ে যাচ্ছেন। রপ্তানিকারকেরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সবজি রপ্তানি করছেন।

বিস্তীর্ণ চলনবিল অঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে বিপুল সম্ভাবনাময়। এ অঞ্চলের উৎপাদিত মাছ, মধু ও শর্ষের ভোজ্যতেল দেশের ঘাটতি পূরণে অনেকাংশে সক্ষম হয়েছে। পরিকল্পিত পদ্ধতিতে ইরি-বোরো ধানসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করে দেশের খাদ্যঘাটতি নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। চলনবিলে এখন বাণিজ্যিকভাবে কুচিয়া মাছ চাষ করা হচ্ছে। এ কুচিয়া মাছ চীনে রপ্তানি করা হচ্ছে। প্রাকৃতিক জলসম্পদের ভান্ডার চলনবিলের বাঁশের মাচায়, ছইয়ে ঢাকা চালার নিচে স্তূপ করে রেখে শুঁটকি শুকানো হয়। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এসব শুঁটকি বাণিজ্যিকভাবে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।

চলনবিলে প্রতিবছর শতকোটি টাকার বেশি লিচু বিক্রি হয়। রসুন আবাদে চলনবিলের চাষিরা দেশে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। দেশের মোট রসুনের প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই উৎপাদিত হয়েছে চলনবিল এলাকায়। চলনবিলে রসুন ‘সাদা সোনা’ নামে খ্যাতি পেয়েছে। এ ছাড়া উৎপাদিত তরমুজ, ক্ষীরা, বাঙ্গি ও কলা চলনবিলের চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়, যা আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

সমস্যা হলো, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্দশা চলনবিলের কৃষকদের পিছু ছাড়ছে না। বছর বছর অকাল বন্যায় ফসল পানিতে তলিয়ে যাওয়া, নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া, বজ্রপাতে কৃষকের মৃত্যু, ফসলে অতি রোগবালাই—সবকিছুতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব লক্ষণীয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চলনবিল ও এর প্রতিবেশ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক জলবায়ু ফান্ড থেকেও ক্ষতির ন্যায্য হিস্যা আদায় করা যাচ্ছে না।

চলনবিলে বজ্রপাতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের অধিকাংশই কৃষি পেশার সঙ্গে যুক্ত। মাঠে কাজ করতে গিয়েই এসব কৃষক মারা যান। বজ্রপাত নিরোধে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর করে বিশ্বের অনেক দেশ সফল হলেও আমরা পিছিয়ে রয়েছি। এ ক্ষেত্রে টেকসই ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।

প্রতিবছর এপ্রিল থেকে জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বজ্রপাতের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যখন কালবৈশাখী হয়, তখন বজ্রপাতের হার বেশি থাকে। চলনবিলে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। বিলে উঁচু কোনো গাছপালা বা স্থাপনা না থাকায় বজ্রপাত সরাসরি মানুষের ওপর আঘাত হানে।

ফসল ফলাতে গিয়ে, গরু মাঠে নিয়ে, মাছ ধরতে গিয়ে বজ্রপাতের আঘাতে একের পর এক কৃষক মারা যাবেন, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। চলনবিলে প্রয়োজনীয় বৃক্ষরোপণ ও বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করা দরকার। সে ক্ষেত্রে বিদ্যুতের খুঁটিগুলোকেও ব্যবহার করা যেতে পারে। পাশাপাশি বজ্রপাত ও বৃষ্টির সময় কৃষক ও জেলেরা যাতে আশ্রয় নিতে পারেন, সে জন্য চলনবিলে ছোট ছোট আশ্রয়কেন্দ্র বা কৃষকছাউনি নির্মাণ করা দরকার। উল্লেখ্য, তালগাছ লাগানো প্রকল্প ফলপ্রসূ হয়নি।

সম্প্রতি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল ইউনিয়নের হাকালুকি হাওরের পূর্ব সিংগুর এলাকায় একটি কৃষকছাউনি স্থাপন করা হয়েছে। ছাউনিটি প্রখর রোদ, ঝড়, বৃষ্টি ও বজ্রপাতের সময় হাওরের জমিতে কাজে থাকা কৃষক ও শ্রমিকদের বিশ্রাম-আশ্রয়স্থল। স্থানীয় একটি ক্লাবের উদ্যোগে নির্মিত কৃষকছাউনিতে বসার জন্য রয়েছে পাকা বেঞ্চ ও পানিপানের জন্য নলকূপ। স্থানীয় সচ্ছল ও প্রবাসী ব্যক্তিরা কৃষকছাউনি নির্মাণে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। ছাউনিতে ২০ থেকে ২৫ কৃষক বসতে পারেন।

কৃষকছাউনি দেশের অন্যান্য এলাকার মানুষের কাছে অনুকরণীয় হতে পারে। তবে কুলাউড়ার কৃষকছাউনি দেশে প্রথম নয়। এর আগে গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং কৃষি বিভাগের আর্থিক সহযোগিতা ও অর্থায়নে আরও কৃষকছাউনি তৈরি করা হয়।

সরকারিভাবে চলনবিল অঞ্চলে এমন কৃষকছাউনি নির্মাণ করা হোক। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কৃষি বিভাগ যে উদ্যোগের সূচনা ঘটিয়েছিল, সেটিকে ধারাবাহিক করা সময়ের দাবি। পাশাপাশি চলনবিলের সুধীজন ও বিত্তশালীদেরও কৃষকছাউনি নির্মাণ করার আহ্বান জানাই। এ ছাড়া বজ্রপাতের ‘হটস্পটগুলো’ চিহ্নিত করে বজ্রনিরোধক দণ্ড ও যন্ত্র বসানো গেলে সেখানে ১০০ মিটার ব্যাসের মধ্যে মানুষ নিরাপদ থাকতে পারবে। চলনবিলে পরীক্ষামূলকভাবে কিছু এলাকায় বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করা হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। নাটোরে বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করা হয়নি; কবে স্থাপন করা হবে তা–ও অনিশ্চিত।

চলনবিলকে রক্ষা করতে হলে বিলের মানুষকে রক্ষা করতে হবে। তাই চলনবিলের মানুষকে বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে কৃষকছাউনি নির্মাণ ও বজ্রদণ্ড স্থাপন করার বিকল্প নেই।

ফাত্তাহ তানভীর রানা
ব্যাংক কর্মকর্তা