বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাউবি তার প্রতিষ্ঠার ৩২ বছর পার করল। ১৯৯২ সালে মহান জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৯২ নামে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বর্তমানে প্রায় ছয় লাখ শিক্ষার্থী এখানে অধ্যয়ন করছে। এসএসসি থেকে পিএইচডি পর্যন্ত পড়াশোনা করার সুযোগ রয়েছে এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাউবি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হলো উন্মুক্ত ও দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদান করা। অর্থাৎ শিক্ষার জন্য একজন মানুষকে প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত উপস্থিত হতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই, বরং উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেকোনো স্থানে বসে শিক্ষা গ্রহণ করা যাবে। উদাহরণস্বরূপ করোনাকালীন ব্যবস্থায় যে শিক্ষাপদ্ধতি চালু ছিল। এ ছাড়া টিভি ও রেডিওতে বাউবির শিক্ষকেরা নিয়মিত বক্তব্য দিয়ে থাকেন।
বাউবির দুটো বিষয় নিয়ে আপামর জনগণের মধ্যে বিভিন্ন মতবাদ দেখা যায়, সেটি হলো বাউবির শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার্থী নিয়ে।
প্রথম প্রশ্ন: মানুষের মুখে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে যে বাউবির শিক্ষার্থী মূলত কারা?
উত্তরটি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৯২–এর ধারা ২ ও ৮-এ বলা আছে।
ধারা দুই অনুযায়ী: বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভর্তি হওয়া যেকোনো নারী ও পুরুষ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলে গণ্য হবে। ধারা ৮–এ আছে যে (১) যে কোন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও শ্রেণির পুরুষ ও মহিলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় উন্মুক্ত থাকিবে। (২) উপ–ধারা (১) এর কোনো কিছুই নারী বা সমাজের অনগ্রসর শ্রেণির কোনো ব্যক্তির নিয়োগ বা ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিবৃত্ত করে বলিয়া গণ্য করা যাইবে না।
অর্থাৎ এর দ্বারা বোঝা যায় যে বাউবি বৈষম্যহীনভাবে যে কাউকে অধ্যয়নের সুযোগ দিয়ে থাকে। উপযুক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতায় বাউবিতে পড়াশোনা করা যায়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের ২৮ অনুচ্ছেদের বাস্তবায়ন বাউবি আইনে ও বাস্তবতায় হয়েছে। বাউবি শিক্ষার্থী যেকোনো বয়সের যেকোনো মানুষ হতে পারবে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন: বাউবির শিক্ষাপদ্ধতি আসলেই কেমন? বই খুলে পরীক্ষা দেওয়া যায়? পড়তে হয় না। নকল করা যায়? কোনো ক্লাস না হলে শিক্ষার্থীরা কীভাবে শিখবে?
প্রশ্ন সবার মনে জাগ্রত হতে পারে। কেননা, বাউবি কেবলই প্রথাগত শিক্ষাপদ্ধতিতে নির্ভরশীল নয়। এটি আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতির প্রবর্তন করেছে।
উত্তরটি এই আইনের ধারা ৯-এ বলেছে যে, শিক্ষাদানের বিভিন্ন কার্যক্রম সংবিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত হইবে এবং করেসপনডেন্স প্যাকেজ, ফিল্ম, ক্যাসেট, টেলিভিশন অনুষ্ঠান, বেতার অনুষ্ঠান, বক্তৃতা, টিউটোরিয়াল, আলোচনা, সেমিনার, পরিদর্শন, প্রদর্শন এবং ল্যাবরেটরি, ওয়ার্কশপ ও কৃষি জমিতে ব্যবহারিক শিক্ষাসহ বাস্তব শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অন্যান্য মাধ্যমে শিক্ষাদান ও প্রশিক্ষণ উক্ত পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত হইবে।
এই বিধানকে বাস্তবে প্রয়োগ করলে দেখা যায় যে বাউবিতে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নির্ধারিত প্রাঙ্গণে গিয়ে অধ্যয়ন করতে পারবে অথবা যেকোনো জায়গায় অবস্থান করে তড়িৎ প্রযুক্তির মাধ্যমে পাঠদান গ্রহণ করতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ বাউবির ঢাকা ক্যাম্পাসে নিয়মিত পাঠদান হয়। আবার অনলাইনে বাউবির শিক্ষকেরা একাডেমিক বক্তব্য দিয়ে থাকেন।
বাউবি শিক্ষার্থীদের নকলের বিষয়টি কেবলই দুর্নীতির ফল। বাউবির কারিকুলামে নকলের অনুমোদন নেই বরং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য শিক্ষাপদ্ধতির মতোই এখানে মুখস্থ ও মেধাভিত্তিক পরীক্ষা হয়ে থাকে। তবে পরিকল্পনাহীনতা, অব্যবস্থাপনা, অনিয়মের কারণে আজও বাউবির আইনের পূর্ণরূপ বাস্তবায়ন হয়নি।
আবার বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাউবির শিক্ষার্থীরা অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মতো সুযোগ–সুবিধা পেয়ে থাকে না। উদাহরণস্বরূপ বাউবিতে শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি নেই, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টে বাউবির শিক্ষার্থীরা নেই, বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় বাউবির শিক্ষার্থীরা হেয়প্রতিপন্নের শিকার হয়ে থাকে, বাউবিতে শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে কার্যকর কোনো ক্লাব নেই, নেই প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের কোনো সংগঠন। যার অভাবে বাউবির শিক্ষার্থীরা অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের থেকে যথেষ্ট পিছিয়ে থাকে।
বাউবির অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা কর্মজীবী। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের যে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়, সেটি তত্ত্বীয়। কর্মজীবী শিক্ষার্থীদের কর্মবিষয়ক শিক্ষা প্রদান করা হলে, সেটি উপকারী হিসেবে কাজে আসবে। তখন জাতীয় উন্নয়নে কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা বাউবি শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়ন হবে।
জিসান তাসফিক
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়