একটি নদীকে শুধু তার ওপরের প্রবাহ দেখে যেমন বোঝা যায় না তার ভেতরের গভীরতা কতটুকু, ঠিক তেমনি একজন মানুষকে তার সার্টিফিকেট বা সিভি দিয়ে মূল্যায়ন করা কতটা যুক্তিযুক্ত?
আজকের দিনে জীবনের মূল্যায়ন পরিণত হয়েছে এক পাতার একটা সিভিতে। সেই পাতায় লেখা থাকবে কে কোন স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন, কার সিজিপিএ কত, কতগুলো কোর্স করেছে, কে কতটা নিজে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে পারেন, কতগুলো কর্মস্থলে কাজ করেছেন, কোন প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্ন করেছেন। কিন্তু সেখানে লেখা থাকে না কত নির্ঘুম রাত কাটিয়ে, কত কষ্ট করে আজ তিনি এই জায়গায় দাঁড়িয়েছেন। এটাও দেখে না তিনি একজন সৎ, ভালো মানুষ কি না।
একটা সিভি জীবনের প্রকৃত মূল্যায়ন করতে পারে না। এটি এমন এক ধরনের মানসিকতা, যা মানুষকে মূল্যায়িত করে সার্টিফিকেট আর স্ট্যাটাস বা ব্যক্তিগত মর্যাদা দিয়ে।
বিশ্বায়ন আর প্রতিযোগিতার চাপে আজকের দিনে আমরা সফলতা বলতে বাহ্যিক অর্জনকে বুঝি, যা সিভিতে লেখা যায়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে চাকরি এমনকি বিদেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিটি ক্ষেত্রে সিভি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এখনকার দিনে শিক্ষার্থীরা অল্প বয়স থেকেই সৃজনশীল কর্মকাণ্ড, কম্পিউটার দক্ষতা, প্রেজেন্টেশন দক্ষতার পেছনে দৌড়ানো শুরু করেন; কারণ একটা ভালো প্রোফাইল তৈরি করতে হবে।
এক জরিপে দেখা গেছে, ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থীই মনে করেন আজকের দিনের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ভারী সিভি প্রয়োজন। তাঁদের মধ্যে ৬২ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছেন তাঁরা যেসব কোর্স করে বা কাজ করেন, সেগুলো তাঁদের তেমন ভালো লাগে না, যা করেন সব সিভির জন্য করেন।
আবার অনেক চাকরিপ্রার্থী বলেন, তাঁরা অনেক জায়গায় কাজের জন্য আবেদন করলেও শুধু সিভির সিজিপিএ আর প্রতিষ্ঠানের নাম দেখে তাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে। নিজেদের দক্ষতা আর চিন্তাধারাকে মূল্যায়ন করার সুযোগ দেওয়া হয়নি তাঁদের।
সিভির এই প্রবণতা দিন দিন মানুষের সম্ভাবনার ওপর বাজে প্রভাব ফেলছে। কারণ, মানুষের সৃজনশীলতা, চিন্তাধারা, মূল্যবোধ এগুলো কখনোই একটা সিভির মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় না।
অনেকে প্রতিযোগিতার প্রথমে খুব একটা এগিয়ে যেতে না পারলেও কঠোর পরিশ্রম, আত্মবিশ্বাস আর দক্ষতার জোরে চাকরি বা ইন্টারভিউ পর্যন্ত পৌঁছেছেন। কিন্তু সেখানেও তিনি অবহেলিত হয়েছেন, বাদ দেওয়া হয়েছে। কারণ শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে বা রেজাল্ট দিয়ে হবে না, এর সঙ্গে থাকতে হবে প্রযুক্তিগত জ্ঞান, বাস্তব অভিজ্ঞতা, ইন্টার্নশিপ আর সঠিকভাবে তৈরি করা সিভি।
বাংলাদেশে একজন মানুষের মান মাপা হয় তাঁর পেশা, আয়, তিনি কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, কোন পদে কাজ করেন—এসব দিয়ে। একজন গুগলে চাকরি করা ছেলে অথবা বিদেশি স্কলারশিপ পাওয়া মেয়েকে সমাজ অনেক ভালো চোখে দেখে, অনেক প্রশংসা করে। যার ফলে তরুণদের মধ্যে নিজেকে ভালো প্রমাণ করার চিন্তাভাবনা গড়ে ওঠে, তাঁরা জমকালো সিভি বানানোর জন্য মত্ত হন দক্ষতা তৈরিতে।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা যেহেতু পরীক্ষা, নম্বর আর সার্টিফিকেটের কাঠামোয় বাঁধা, তাই এখানে মানসিক স্বাস্থ্য, মানবিকতা, মূল্যবোধ এগুলোকে এক্সট্রা কারিকুলার হিসেবে ধরা হয়।
আবার অনেক প্রতিষ্ঠান একধরনের রোবোটিক ফিল্টার ব্যবহার করে, যা নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা না থাকলে সিভি বাদ দিয়ে দেয়। এ কারণে মানুষ তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা, চিন্তাশক্তি, মানবিক মূল্যবোধ প্রমাণ করার সুযোগ পান না।
কেউ হয়তো আঁকতে খুব ভালোবাসেন। কিন্তু সমাজ যে ভালো চাকরি ছাড়া কাউকে মূল্য দেয় না, তাই তিনি বিভিন্ন কোর্স করে স্কিল তৈরি করেছেন একটা ভালো সিভি বানিয়ে ভালো চাকরি পাওয়ার আশায়। নিজের পছন্দের কাজ বাদ দিয়ে অন্য কাজের পেছনে ছুটতে গিয়ে তিনি হয়তো এখন নিজের মধ্যে নিজেকেই খুঁজে পান না।
মা–বাবা অনেক সময় সন্তানের কোনো কাজ পছন্দ, এটা অবহেলা করেন। তাঁরা চান তাঁদের সন্তান যেন বড় চাকরি বা বিদেশে পাড়ি দিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে। এতে সন্তানদের ওপর পরোক্ষ চাপ পড়ে। তাঁরা নিজেদের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে ভালো চাকরির আশায় সিভি বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
আমাদের সমাজকে বুঝতে হবে একজন মূল্য সার্টিফিকেট দিয়ে করা যায় না। মূল্যায়ন করতে হবে তাঁর অভিজ্ঞতা, সৃজনশীলতা আর চিন্তাশক্তির মাধ্যমে। চাকরিতে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় সার্টিফিকেটের মূল্যায়ন এর থেকে মানুষের গুণাবলির মূল্যায়ন দিতে হবে। বর্তমানে গুগল,অ্যাপলসহ অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান স্কিল বেসড হাইরিং পদ্ধতি চালু করেছে। আমাদেরও উচিত সেই পথে হাঁটা।বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমন পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজের আগ্রহ ও স্বপ্ন প্রকাশ করতে পারবেন এবং ব্যক্তিগত উন্নয়নে কাজ করতে পারবেন। আমরা যদি স্কুল থেকেই মানবিক গুণাবলি, সহনশীলতা আর সমাজ নিয়ে চিন্তা করতে শেখাই, তাহলে শিক্ষার্থীরা সিভির বাইরের পৃথিবীটাকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু করবেন। অভিভাবকদের বোঝাতে হবে সন্তান সিভির পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে যদি জীবনের জীবনের আনন্দ হারিয়ে ফেলেন, তাহলে সেই সফলতা অর্থহীন হয়ে পড়বে। সিভির পরিবর্তে প্রার্থীদের নিজ দক্ষতা প্রদর্শন, অভিজ্ঞতা শেয়ারের সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা যেতে পারে।
মানুষকে এক পাতার সিভি দিয়ে বিচার করাটা দিন দিন এক ভয়ংকর সংস্কৃতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যেখানে ভুল করা মানে ব্যর্থতা আর নিজের পথে হাঁটা মানে ঝুঁকি।
সফলতা মানে চাকরি পাওয়া নয়, সফলতা মানে নিজের ইচ্ছাকে মূল্য দেওয়া, নিজের মতো করে বাঁচা আর সমাজে কিছু রেখে যাওয়া। সেই পথ সবার জন্য এক না। কেউ লেখালেখির মাধ্যমে সমাজ বদলাবে, কেউ শিক্ষকতার মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম গড়বে, কেউ জমিতে চাষ করে খাদ্যের জোগান দেবে।
এই প্রতিটি জীবনকেই সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া উচিত।
সিভি সফলতার দরজার চাবি হতে পারে; কিন্তু জীবন নামের যে অমূল্য পথচলা, তা কেবল এই দরজার পেছনে
ঘটে না।
আরমীন আমীন
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা