পোষ্য কোটা: চাকরি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে বঞ্চনার নাম

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে মেধাবীদের উচ্চ শিক্ষার এক স্বপ্নের জায়গা। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয় করে ভালো পরীক্ষা দিয়েও এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া অনিশ্চিত। এর প্রধান কারণ ভর্তিতে কোটা পদ্ধতি। প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষায় একজন শিক্ষার্থী অন্যদের চেয়ে শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য এক নম্বর কম পাওয়ার কারণে যেখানে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না; সেখানে কোটার কারণে অনেক কম নম্বর পেয়েও বহু শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ নিচ্ছে।এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেও কোটার ভিত্তিতে চান্স পেয়েছে।

এর অকাট্য উদাহরণ হলো, ২৭ জানুয়ারি ২০২২ সালে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে আমরা দেখি, পাস করলেই পোষ্য কোটায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগের কথা।
৮ নভেম্বর ২০২২ সালে দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক ভর্তি পরীক্ষায় পোষ্য কোটায় ৭১ জন প্রার্থী অকৃতকার্য হয়েও ভর্তির সুযোগ পেয়েছে।

সংবিধানে যেখানে বলা আছে কোটা অনগ্রসর ব্যক্তিদের জন্য রাখা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে পোষ্য কোটা রাখা হয়েছে সেগুলো মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব শিক্ষক-কর্মকর্তাগণ কোন দিক দিয়ে অনগ্রসর, সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়।
অথচ কোটা পদ্ধতি ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলের। কিন্তু তা ছিল সীমিত পর্যায়ে উচ্চতর পদেই আর সীমিত আকারে। স্বাধীনতার পর থেকে একেক সরকারের আমলে পর্যায়ক্রমে চাকরি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে কোটার পরিধি বিস্তৃত হয়। যার কারণে মেধাবীদের বঞ্চিত হতো প্রবলভাবে। এ বঞ্চনার বিরুদ্ধে কোটা বিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠলে সরকার কোটা সংস্কার করতে বাধ্য হয়। কিন্তু অনেক সরকারি চাকরিতে কোটায় নিয়োগ এখনও বহাল রয়ে গেছে।

সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ ২০২০ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৩৭ হাজার ৫৭৪ জন প্রার্থীকে ১৪ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়। এ পরীক্ষার নিয়োগে ৬০ শতাংশ নারী কোটা, ২০ শতাংশ পোষ্য কোটা, ২০ শতাংশ পুরুষ কোটা প্রয়োগ করে যেখানে এই কোটার ওপর ২০ শতাংশ বিজ্ঞান কোটা রাখা হয়। সে হিসেবে নারী ও পোষ্য নারী ২৬ হাজার ৩০২, পোষ্য পুরুষ ৩ হাজার ৭৫৭ এবং পুরুষ মেধায় ৫ হাজার ৭১৫ জন নিয়োগপ্রাপ্ত হন। কোটা ব্যবস্থার বেড়াজালে পরে বাংলাদেশের সরকারি নিয়োগের একটা বড় খাত সহকারী শিক্ষক নিয়োগে বৈষম্যের  কারণে বঞ্চিত হচ্ছে যোগ্য জনেরা।

অদৃশ্যমান এই কোটা ব্যবস্থায় প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ রাজনীতির ধূম্রজাল বুনে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে অযোগ্যদের চাকরির সুযোগ করে দেন। ফলে যোগ্যরা হারাচ্ছে তাদের কর্মসংস্থান এবং তৈরি হচ্ছে অযোগ্যদের এক বিশাল বলয়। এই দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান কোটা ব্যবস্থার রোষানলে পরে প্রতি বছর কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা এবং চাকরি থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে লক্ষাধিক মেধাবী শিক্ষার্থীকে। যে রাষ্ট্র  স্বাধীন হয়েছে গরিব মেহনতি মানুষের অধিকার প্রদানের জন্য, তা আজ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। গরিব ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের অনেক স্বপ্ন থাকে, তারা ভালো একটা চাকরি পেয়ে মা-বাবার মুখে হাসি ফোটাবে। কিন্তু তাদের এ স্বপ্ন অধরাই  থেকে যায় কোটা নামক বৈষম্যের কাছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগের জন্য সবার সমান সুযোগের কথা বলা হয়েছে। তবে উপ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো অনগ্রসর অংশের (প্রতিবন্ধী ও উপজাতি) জন্য বিশেষ বিধান রাখার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে সরকারি চাকরির বাজারে বড় একটি অংশের প্রার্থী পোষ্য কোটার সুবিধাভোগী। তাহলে সংবিধান সবার সমান অধিকারের যে নিশ্চয়তা দেয়, তা কতটুকু বাস্তব সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।

সম্প্রীতি, পোষ্য কোটা বাতিলে ডিসিদের সুপারিশ নজরকাড়ার মতো। কিন্তু অধিকাংশ কোটা ব্যবস্থা এখনও রয়েই গেছে। এই অযৌক্তিক কোটা ব্যবস্থা বাতিল করা এখন সময়ের দাবি। এতে মেধাবীরা  অর্জন করবে তাদের যোগ্য স্থান। দেশের কল্যাণে কোটা পদ্ধতি বাতিলের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

  • মো. আনোয়ার হোসেন
    শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর