কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিতিশীলতা কাটবে কবে?

শিক্ষক সমিতি ও উপাচার্য দ্বন্দ্বে গেল কয়েক মাস ধরেই অস্থিতিশীল কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। একের পর এক ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন থেকে শুরু করে মৌখিক বাগ্‌বিতণ্ডা এখন সংঘাতে রূপ নিয়েছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নির্বাচন শেষে উপাচার্য কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাতের সময়ে মূলত শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মাঝে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সে সূত্র ধরে বিচারের দাবি নিয়ে শিক্ষক সমিতির আন্দোলন শুরু হয়। তবে শুরুতে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চাইলে এ সমস্যা সমাধান করা যেত। কিন্তু প্রশাসনের তরফ থেকে তা করা হয়নি। ফলে শিক্ষক সমিতির সাত দফা এবং পরবর্তীতে এ সাত দফা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে এক দফায় গড়িয়েছে।

ঈদের আগে শিক্ষক সমিতি প্রায় অর্ধ মাসের মতো ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করেছিল। শিক্ষার্থীদের আশা ভরসা ছিল ঈদের ছুটি শেষে এ সমস্যা নিরসন হবে এবং পরীক্ষাগুলো ঠিকঠাক সম্পন্ন হবে। কিন্তু হয়েছে তার বিপরীত।

দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের জেরে জরুরি সিন্ডিকেট সভায় বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। অতীতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক ঝামেলার কারণে বন্ধ ঘোষণা করা হতো। কিন্তু এখন শিক্ষকদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এমন নজির কোথাও আছে কিনা জানা নেই।

চুন থেকে পান খসলেই ক্লাস বর্জন, পরীক্ষা বর্জন করা হয়। এত দিন করত শিক্ষক সমিতি এখন করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে দুপক্ষের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। চূড়ান্ত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকেরা ক্লাস না নিলেও বেতন পাবেন, প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা ঠিকঠাক পাবেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা? শিক্ষার্থীরা একদিন ক্লাস বর্জন বা একটি পরীক্ষা পেছালে প্রতিযোগিতার এই যুগে পিছিয়ে যাবে অনেক দূর। তা ছাড়াও শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে টিকেছেন।

তাদের ক্ষেত্রে এই সমীকরণ আরও জটিল। বোবা চিৎকারে আর্তনাদ করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। স্নাতক চূড়ান্ত বর্ষের শিক্ষার্থীরা অনেকগুলো চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করার সুযোগ পাবে না। অথচ পরিবারের কতগুলো মুখ তাকিয়ে আছে বড় ভাই কিংবা বোনটির ভালো একটি চাকরির আশায়।

শিক্ষক-প্রশাসনের এই দ্বন্দ্ব হয়তো একদিন মিটে যাবে। কিন্তু পরীক্ষাগুলোর কী হবে? বিশ্ববিদ্যালয় খোলা মাত্র সেশন জট এড়াতে তাড়াহুড়ো করে হয়তো একনাগাড়ে সবগুলো পরীক্ষা বিরতিহীন নিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু এতে কি শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না? প্রতি সেমিস্টারে ২টি করে মিডটার্ম পরীক্ষা নেওয়া হয়। দুটা পরীক্ষার মাঝে সময়ের ফারাক থাকে সাধারণত দেড় মাস। ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের কবলে পড়ে অধিকাংশ বিভাগে চলতি সেমিস্টারের সব কটি মিডটার্ম ঝুলে আছে।

এখন বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর যদি সবগুলো মিডটার্ম একসঙ্গে নিয়ে নেওয়া হয় তাহলে শিক্ষার্থীদের এই চাপের ভার সহ্য করবে কে? ডিপার্টমেন্ট ভেদে সব মিলিয়ে ৮-১০টি মিডটার্ম পরীক্ষা দিতে হবে শিক্ষার্থীদের। নির্ধারিত সময় জুলাই মাসে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা নিতে হলে প্রেজেন্টেশন, অ্যাসাইনমেন্ট, টিউটোরিয়ালসহ সবকিছু শেষ করতে হবে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে।

৬ মাসের কোর্স এক মাস বা ১৫ দিনে সমাপ্ত করে দিলে শিক্ষার্থীদের অর্জনের খাতা শূন্য হলেও কারো কোনো ক্ষতি নেই। মানসিক চাপ ও শারীরিক বোঝার কথাও কেউ চিন্তা করছে না। দাবি মানা অথবা না মানা শিক্ষকদের মধ্যকার ব্যাপার। এতে শিক্ষার্থীদের কেন জড়ানো হচ্ছে বোধগম্য নয়।

প্রতিষ্ঠার ১৭ বছরে অভ্যন্তরীণ নানাবিধ সমস্যার কারণে পিছিয়ে আছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। সমপর্যায়ের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় এবং ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় যতটুকু এগিয়ে যাওয়া প্রত্যাশা ছিল, ততটুকু পৌঁছাতে পারেনি বিদ্যাপীঠটি।

এর মূল কারণ বিভিন্ন সময়ের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। দ্রুত চলমান সংকট নিরসন করার ব্যবস্থা না করা হলে করোনাকালীন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ও সেশন জট এড়াতে যথাসময়ে সেমিস্টার সম্পন্ন করার যে অসাধারণ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তা অচিরেই ব্যর্থ হবে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ উচ্চমহলের হস্তক্ষেপ অতীব জরুরি।

  • আবু মো. ফজলে রোহান
    শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
    ই-মেইল: [email protected]