লক্ষ্মীপুরে কি উন্নয়ন হবে না?

মজুচৌধুরীরহাট লঞ্চঘাট থেকে বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনা বিভাগের ২১ জেলার মানুষ এ নৌ-রুট দিয়ে চলাচল করে আসছে।

লক্ষ্মীপুর বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত একটি জেলা। মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেঁষে গড়ে ওঠা জেলাটিতে কোনো দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়নি বললেই চলে। লক্ষ্মীপুরকে অনেকে বিএনপির ঘাঁটি ভেবে থাকলেও, বিএনপিও এই জেলার তেমন কোনো উন্নয়ন করে যেতে পারেনি। আওয়ামী লীগের আমলেও এই জনপদে উন্নয়ন অধরাই থেকে গেল।

এখানে নেই কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, নেই কোনো মেডিকেল কলেজ, নেই কোনো উন্নত শিল্প কারখানা বা উল্লেখযোগ্য কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান। রাস্তাঘাট তো যথেষ্ট ভাঙাচোরা। স্বয়ং সদর উপজেলাতেই রাস্তাঘাটের জরাজীর্ণ অবস্থা। মাঝে মাঝে মনে হয় এই জেলার কোনো মা-বাপ নেই। এই লক্ষ্মীপুরে যেন এখনো সভ্যতার আলো পৌঁছেনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। উন্নত মানের তেমন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও নেই। শিক্ষার হারের দিক দিয়েও এ জেলা অনেক পিছিয়ে। সারা দেশ জুড়ে লোডশেডিং চললেও লক্ষ্মীপুর প্রত্যন্ত অঞ্চল হাওয়ায় এ অঞ্চলে লোডশেডিংয়ের মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে যায়। তবে আশার কথা লক্ষ্মীপুরে স্থাপিত হতে যাচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এ জন্য ইতিমধ্যে ‘লক্ষ্মীপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০২৩’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।

লক্ষ্মীপুরের যাতায়াত ব্যবস্থাও অত্যন্ত তথৈবচ। ঢাকা-চট্টগ্রামে আসা যাওয়ার ক্ষেত্রে লক্ষ্মীপুর থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো যাতায়াত ব্যবস্থা নেই। কারণ এই জেলা রেল যোগাযোগের আওতাভুক্ত নয়। কাজেই বাসই হলো সড়কপথে যাতায়াতের একমাত্র অবলম্বন। বাণিজ্যিক সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে ১৯৭৩ সালে লক্ষ্মীপুরে রেললাইন স্থাপনে জরিপ চালানো হয়। তবে নানা জটিলতায় ৫০ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি এ উদ্যোগ।

লক্ষ্মীপুর নারকেল, সুপারি, সয়াবিন ও ধান উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। কৃষিনির্ভর এ জেলায় প্রায় ১৮ লাখ মানুষের বসবাস। তবে দেশে যেসব জেলার সঙ্গে বিমান ও রেল যোগাযোগ নেই, তার একটি হলো লক্ষ্মীপুর। অথচ লক্ষ্মীপুরের পাশের জেলা চাঁদপুর ও নোয়াখালীতেও রেল যোগাযোগ রয়েছে। জেলাটির প্রায় ৩৫ শতাংশ জনগণ কৃষি কাজের সাথে জড়িত। সয়াবিন, নারিকেল, সুপারি ও বিপুল পরিমাণ ধান উৎপাদনের জন্য এই জেলা প্রসিদ্ধ। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সয়াবিন উৎপাদন হয় এই জেলাটিতে। অথচ রেল সংযোগ না থাকায় ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত হওয়ায়, এ জেলার কৃষি পণ্য ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ঢাকা-চট্টগ্রামে আনা-নেওয়াতে বেগ পেতে হচ্ছে।

দূরপথে যাতায়াতের ক্ষেত্রে বাসই একমাত্র অবলম্বন হওয়ায়, বাসমালিকেরা এখানে একচেটিয়া রাজত্ব করছে। বাস ভাড়া বাস্তবতা বিবেচনায় অত্যধিক। আবার ঢাকা বা চট্টগ্রাম যাতায়াতের ক্ষেত্রে বাসের সংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় কম। হাতেগোনা দুই একটা কোম্পানির বাস এ অঞ্চল থেকে ঢাকা বা চট্টগ্রামে যাতায়াত করে। অন্য কোম্পানির বাসকে কোনো এক অদৃশ্য কারণে ঢাকা-লক্ষ্মীপুর রুটে বা ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছে না। কাজেই যাত্রীরা ওই বাসগুলোর কাছে জিম্মি।

যাতায়াতের ক্ষেত্রে উন্নত মানের কোনো বাস নেই। বাসের অভ্যন্তরীণ পরিষেবাও অত্যন্ত নিম্নমানের। অনেক সময় তারা যাত্রীদের সাথে দুর্ব্যবহার করে, পথে পথে লোক ওঠায়। অধিকন্তু দেশের শীর্ষস্থানীয় বাস কোম্পানিগুলো এ অঞ্চলে ঢুকতে পারছে না। যদি দেশের স্বনামধন্য বাস কোম্পানিগুলো এ অঞ্চলে প্রবেশাধিকার পেত, তাহলে বাসযাত্রীদের কষ্ট আরও লাঘব হতে পারত।

ওদিকে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের ছয় বছর পার হলেও এখনো অগ্রগতি নেই লক্ষ্মীপুরের মজু চৌধুরীর হাটের নৌ-বন্দর নির্মাণের। লক্ষ্মীপুর শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে মজুচৌধুরীরহাটের অবস্থান। এ মজুচৌধুরীরহাট লঞ্চঘাট থেকে বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনা বিভাগের ২১ জেলার মানুষ এ নৌ-রুট দিয়ে চলাচল করে আসছে। এ নৌ-বন্দর বাস্তবায়িত হলে ২১ জেলার মানুষের মধ্যে যোগাযোগের নতুন সেতুবন্ধন তৈরি হতো। প্রসার ঘটতো লাখ লাখ মানুষের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের।

এখানে নৌ-বন্দর নির্মাণ করার জন্য দীর্ঘদিনের দাবি ছিল এ অঞ্চলের মানুষের। এ দাবির প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ১৪ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লক্ষ্মীপুরে এসে নৌ-বন্দর নির্মাণ প্রকল্পসহ বেশ কিছু কাজের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।  কিন্তু ঘোষণার ছয় বছর অতিবাহিত হলেও এখনো বন্দর নির্মাণের কোনো অগ্রগতি নেই।
অধিকন্তু মেঘনা নদীর ভাঙনে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর ও রামগতি উপজেলার অনেক অধিবাসী সবকিছু হারিয়ে বাস্তুহারা ও সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। সরকার নদী ভাঙন রোদে যেসব প্রকল্প হাতে নিয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সরকার উদ্যোগী হয়ে এই জেলায় তেমন কোনো দৃশ্যমান অবকাঠামোগত উন্নয়নের ব্যবস্থা নেয়নি। সদিচ্ছা থাকলে লক্ষ্মীপুরের আলেকজান্ডারসহ আরও কিছু অঞ্চলে পর্যটনকেন্দ্র করা সম্ভব।

উন্নয়ন বৈষম্য নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেন, লেখেন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় সেসব লেখায় লক্ষ্মীপুরের স্থান নেই। ঢাকা শহরের অদূরে অবস্থিত বলে এ অঞ্চলের প্রতি সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই।

বর্তমান সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের মধ্যে লক্ষ্মীপুর জেলা থেকে একজন প্রতিনিধিও নেই। কাজেই সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে লক্ষ্মীপুর জেলার কোনো প্রতিনিধি না থাকায় এই জেলার প্রতি কারও তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। বিভিন্ন জেলায় দেখা যায় প্রভাবশালী মন্ত্রীরা বহুমাত্রিক প্রভাব খাঁটিয়ে নিজ নিজ জেলায় উন্নয়ন সাধন করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে লক্ষ্মীপুর জেলা থেকে কোনো উচ্চ স্থানীয় নেতা নেই বলে এই জেলার উন্নয়ন আরও বেশি তিরোহিত হয়ে গেছে।

সরকারের উপর মহলের কাছে অনুরোধ করব, দেশের এই প্রত্যন্ত জেলাটির প্রতি সুনজর দিন। মানুষের মন জয় করুন। অবকাঠামোগত উন্নয়ন করুন। উন্নয়নের নামে বৈষম্যমূলক নীতি পরিহার করুন। ইন্টারনেটের যুগে মানুষ এখন আর বোকা নয়। মানুষ দেখছে কোথায় কী উন্নয়ন হচ্ছে এবং কোথায় মানুষ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। মানুষ অন্ধভাবে কোন দলকে সমর্থন করে না। যে সরকার সুষম উন্নয়ন করবে, কোনো জনপদকে অবহেলা ও বঞ্চিত করবে না, জনগণ তাকেই ভালোবাসবে এবং ক্ষমতায় দেখতে চাইবে। কোনো অঞ্চল মিছামিছি কেন সুনির্দিষ্ট কোনো দলের  ঘাঁটি হয়ে থাকতে চাইবে, যদি তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন না ঘটে?

মো. শিহাব উদ্দিন
সাবেক শিক্ষার্থী
সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বর্তমানে চাকরি প্রার্থী