শ্রমিকদের শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন হোক

শ্রমিক জাতি সব সময় মালিকপক্ষ দ্বারা অবহেলিত। সঠিক বেতন না পাওয়া, কর্মদিবস মাত্রাতিরিক্ত করানো এবং কোনো অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেলে চাকরিচ্যুত করার হুমকি। যেখানে শ্রমিকেরা একপ্রকার নিপীড়িত হয়ে আসছেন দিনের পর দিন।

এখনো শ্রমিকদের নির্দিষ্ট শ্রমঘণ্টা, ন্যূনতম মজুরি, বেতনবৈষম্য দূর করার দাবিতে আন্দোলনে নামতে হয়। শ্রমিকেরা একটি দেশের মূল চালিকা শক্তি। চারদিকে ইট–পাথরের বহুতল ভবন তৈরি এবং শিল্পকারখানা স্থাপনের মধ্য দিয়ে দেশ ও পৃথিবীর এত অগ্রগতি, যার সবকিছুই সাধারণ শ্রমিকদের দ্বারা গঠিত। মালিকপক্ষ তাঁদের ঘাম ঝরানো শ্রমেই বিলাসিতার জীবন যাপন করছে। কিন্তু সেই মালিকপক্ষ থেকে শ্রমিকেরা তাঁদের ন্যায্য অধিকার আদায় নিয়ে শঙ্কিত। শ্রমিকদের শ্রম দিয়েই সভ্যতার আমূল পরিবর্তন, অথচ সে অনুযায়ী পরিবর্তন হয়নি শ্রমিকদের ভাগ্যের।

উন্নত দেশগুলোতে শ্রমিকের বেতন, ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা সম্মানজনক হলেও ভাগ্য বদলায়নি উন্নয়নশীল দেশের শ্রমিকদের। তাঁরা প্রতিনিয়ত শিকার হচ্ছেন শোষণ ও বঞ্চনার। দেশেও এখন সেই চিত্র লক্ষ করা যায়! দেশে এখনো গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলনে নামতে হয় তাঁদের অধিকার আদায়ে। বেতন, ভাতা থেকে শুরু করে সবকিছুতে তাঁরা অবহেলিত হয়ে আসছেন দিনের পর দিন। এই দেশ জনবহুল এবং উন্নয়নশীল হওয়ায় মালিকপক্ষ তাঁদের সুবিধামতো সাধারণ শ্রমিকদের ব্যবহার করে আসছে। তারা শ্রমিকদের অল্প বেতনে মাত্রাতিরিক্ত কাজ করিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষর করে শ্রমিক অধিকার আদায়ের স্বীকৃতি দিলেও সচেষ্ট নয় সেই অধিকার আদায়ে। দেশে পোশাকশিল্পে কর্মরত ৭৫ ভাগ নারী বেতনবৈষম্য থেকে শুরু করে প্রতিনিয়ত শিকার হচ্ছেন নানা নির্যাতনের।

মে দিবসে শ্রমিকদের নিয়ে ওপরমহলের নানা প্রতিশ্রুতিমূলক বক্তৃতা শোনা যায়। এই প্রতিশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে শ্রমিকদের আনন্দ–উল্লাসে কাটানোর কথা ছিল। তবে প্রতিশ্রুতি কেবল প্রতিশ্রুতিতেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। এখনো শ্রমিকদের রাস্তায় নামতে হয় ওপরমহলের দেওয়া প্রতিশ্রুতি এবং ন্যায্য দাবি আদায়ে।

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ সালের ৪২ নম্বর আইনের ১৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কর্মস্থলে কোনো শ্রমিক দুর্ঘটনার শিকার হলে তাঁকে সম্মানজনক ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। অথচ সেই আইন কাগজে–কলমে স্বাক্ষরিত হলেও হয়নি বাস্তবায়ন। যার অন্যতম উদাহরণ: ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা দুর্ঘটনা। যেখানে ৮ তলা বিল্ডিং ধসে পড়ে এবং ১১ শর বেশি শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এটি শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্ব-ইতিহাসে ঘটে যাওয়া অন্যতম ভয়াবহ শিল্প–দুর্ঘটনা। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় হতাহতদের জন্য সরকার ১২২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিলেও সেই টাকা অনেক শ্রমিক পরিবারের কাছে না পৌঁছার অভিযোগ আছে। অনেকে ক্ষতিপূরণ পেলেও, যে পরিমাণ পাওয়ার কথা ছিল, তা পাননি। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হচ্ছে মালিকপক্ষের অবহেলাকে। মালিকপক্ষের এমন অবহেলার কারণে কর্মস্থলে অনেক শ্রমিক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।

শ্রমিকদের কাজে নিয়োগের আগে তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের মতে, ২০২১ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৫৩ শ্রমিক নিহত এবং ৫৯৪ শ্রমিক আহত হয়েছেন। অথচ কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকরণ ও নিরাপত্তাসুবিধা প্রত্যেক শ্রমিকের বৈধ এবং আইনগত অধিকার। রানা প্লাজা এবং অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার মূলে রয়েছে শ্রমিকদের নিরাপত্তাকে অগ্রাহ্য করা।

সুতরাং এখন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে শ্রমিকদের স্বার্থ এবং সম্মান রক্ষার্থে ওপরমহলের নজর দেওয়া। কারণ, তাঁদের ঘামে তৈরি আজকের এই সভ্যতা। মালিকপক্ষকে শ্রমিকদের ওপর সদয় হতে হবে এবং ন্যায্য দাবি আদায় করতে হবে। শ্রমিকদের নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদান এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দেশে ২০০৬ সালের শ্রমিক আইন শুধু হাতে–কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে শ্রমিকেরা ফিরে পাবেন তাঁদের ন্যায্য অধিকার। শ্রমিকশ্রেণির অধিকার আদায়ে সরকারি-বেসরকারি উভয় পক্ষকে আন্তরিক হতে হবে। যদি তাঁরা জোরালোভাবে আন্তরিক হতে পারেন, হয়তো শ্রমিকদের শ্রমের সঙ্গে সঙ্গে বদলাবে দেশ এবং বদলাবে তাঁদের ভাগ্যও।

মাইন উদ্দীন হাসান

শিক্ষার্থী, মার্কেটিং বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

ই-মেইল:[email protected]