অটিজমে আক্রান্ত ছেলের কর্মজীবী মায়ের দুঃখ

বেশ কিছুদিন হলো বাবার সঙ্গে এক ব্যাংকে গিয়েছিলাম। ব্যাংকে গিয়ে এমন একটি হৃদয়বিদারক ঘটনার সাক্ষী হব, কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। ছেলেটিকে দেখে মনে হলো বয়স ১২ বছরের আশপাশেই হবে। ছেলেটির মা ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা। ছেলেটি সেদিন তার মায়ের সঙ্গে প্রথম ব্যাংকে এসেছিল। ছেলেটির হাবভাব কেমন যেন একটু অন্য রকম ছিল। প্রথমে বুঝতে না পারলেও বেশ কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারি ছেলেটি অটিজমে আক্রান্ত। কিছু মানুষ সে বিষয়ে বলাবলি করছিল। ওই মা তাঁর সন্তানকে বলছিলেন, ‘তন্ময় বাবা এমন করে না, ভালো করে গেম খেলো তুমি জিতবে।’ এ রকম নানা ধরনের আশ্বাস দিচ্ছিলেন ছেলেটির মা। কিছুক্ষণ পর ব্যাংকের ম্যানেজার এসে ওই নারীকে বলতে লাগলেন, এ রকম ছেলেকে ব্যাংকে নিয়ে আসছেন কেন? তখন ওই মা উত্তরে বললেন, ‘স্যার, কালকে থেকে আমার ছেলেটা কান্না করছে আমার সঙ্গে ব্যাংকে আসবে।’ তখন ব্যাংক ম্যানেজার বললেন, ‘আচ্ছা হয়েছে, এখন ছেলেকে বাসায় রেখে আসেন তারপর কাজে করেন। দেখছেন না অনেকে কাজে মনোযোগ দিতে পারছে না।’ ছেলেটির মা বললেন, ‘আচ্ছা স্যার, ঠিক আছে।’

আমি কথাগুলো শুনছিলাম এবং দেখতে পেলাম ছেলেটির মায়ের চোখে পানি। একজন এসে যখন ছেলেটিকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন আমি কৌতূহলবশত তাঁর মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার ছেলে কোন শ্রেণিতে পড়ে?’ তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘কোনো শ্রেণিতে পড়াশোনা করে না।’ জানতে চাইলাম, ‘কেন স্কুলে ভর্তি করেননি?’ উত্তর তিনি বললেন, ‘আমার ছেলেকে কোনো স্কুলই ভর্তি করতে চায় না। যেখানে তাকে ভর্তি করাতে গিয়েছি, সেখানেই অপমানিত হতে হয়েছে এবং বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। আমি তাকে নিজেই পড়াই। মানুষ তাকে দেশের বোঝা ভাবতে পারে, কিন্তু আমার ছেলে কখনোই আমার কাছে বোঝা নয়।’

আমি মনে করি, অটিজম আক্রান্ত শিশুরা দেশের বোঝা নয় বরং সম্পদ। তাদের সঠিক পরিচর্যা করতে হবে ও ভালোবাসতে হবে। তাদের সব ক্ষেত্রেই অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। সমাজের সব মানুষকে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের সঙ্গে মেলামেশা করতে হবে। তাহলে তারা নিজেদের স্বাভাবিক ভাবতে শুরু করবে এবং তারাও দেশের উন্নয়নে অংশীদার হবে।

এ ছাড়া তিনি ছেলেটির বিভিন্ন প্রতিভার কথা বললেন; কিন্তু এগুলো বিকশিত করার জন্য কোনো সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। কথাগুলো আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেল। না জানি তন্ময়ের মতো অটিজমে আক্রান্ত অন্য শিশুকেও এ রকম নানা বঞ্চনা ও অপমানের শিকার হতে হচ্ছে। আমি নারী, পুরুষ কিংবা প্রতিবন্ধী যেটাই হই না কেন, সবকিছুর ঊর্ধ্বে আমি একজন মানুষ। আর এটাই হচ্ছে আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।

মানবাধিকার সূত্রে, মানুষ হিসেবে কিন্তু সবাই সমান সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এর সঙ্গে শিশুদের জন্য রয়েছে বাড়তি অধিকার, যাকে আমরা জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ বলে থাকি। নানা ক্ষেত্রে এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা। আমাদের দেশের জাতীয় শিশু নীতি ২০১১–তেও বলা আছে অটিস্টিক শিশুদের অধিকারের কথা। আমরা যদি সেদিকে একটু আলোকপাত করি, তাহলে দেখতে পাই যে অটিজমে আক্রান্তদের শিক্ষাসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের অধিকারের কথা সেখানে বলা আছে। তবু আমাদের দেশে অটিজম আক্রান্ত শিশুরা সে অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবু অটিজম আক্রান্ত শিশুদের সমাজের ভয়ে আড়াল করে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী করে রাখছেন অভিভাবকেরা। একজন শিশু যদি অটিজম আক্রান্ত হয়, এটি কি তার দোষ?

অটিজম একটি স্নায়ু বিকাশগত সমস্যা। অটিজমে আক্রান্ত তো আপনি কিংবা আপনার সন্তানও হতে পারত? আমরা কি কখনো নিজেদের সেই প্রশ্ন করছি? আমাদের সমাজের কিছু মানুষ রয়েছে, যারা অটিজমের আক্রান্ত শিশুদের দেশের বোঝা মনে করে এবং সমালোচনা করতে অনেক ভালোবাসে। মূলত এ কারণেই অটিজম আক্রান্ত শিশুদের অভিভাবকেরা তাদের আড়াল করে রাখে। যত দিন যেতে থাকে, অটিজম আক্রান্ত শিশুরা বড় হতে থাকে এবং আস্তে আস্তে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের বিভিন্ন লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। তারপর আসে শিক্ষাব্যবস্থা। যদিও সরকারের গৃহীত শিক্ষানীতি সব শিশুর জন্য শিক্ষার সুযোগ এনে দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন এই যে অটিজম আক্রান্ত শিশুরা কতটুকু লাভবান হচ্ছে? কিছু শিশুর বেলায় তো এমনটি ঘটছে যে কোনো স্কুলই তাকে ভর্তি নিচ্ছে না; কারণ কোনো শিক্ষকই তাকে শিক্ষা দিতে উৎসাহী নন। তাঁদের ধারণা, তারা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে না। এ ছাড়া আমাদের দেশের শহরাঞ্চলে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট বিদ্যালয় থাকলেও গ্রাম কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে তা নেই। যে কারণে গ্রামে অটিজম আক্রান্ত শিশুরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

বেশির ভাগ অটিজম আক্রান্ত শিশুর বিশেষ কিছু গুণ থাকে। যেমন কেউ অনেক ভালো ছবি আঁকতে পারে, আবার কেউ ভালো গান গাইতে পারে, কেউ গণিতে কিংবা কম্পিউটার খুবই দক্ষ হয়ে থাকে। কিন্তু সমাজে তাদের এই প্রতিভাগুলো বিকাশের সুযোগ দেওয়া হয় না। এসব শিশুর প্রতিভা থাকলেও তারা তা কাজে লাগাতে পারছে না। এর একটিই কারণ, সমাজের মানুষ মনে করে তারা কিছুই পারবে না, তারা দেশের বোঝা। কিন্তু বিশ্বে অটিজম আক্রান্ত অনেক ব্যক্তি আছেন, যাঁরা জীবনে সফল হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ডেরিল হান্না। তিনি অটিজমকে জয় করে হলিউডের একজন অভিনেত্রী হয়েছিলেন। অটিজম জয় করার কথাটা তিনি নিজেই বলেছিলেন। তাঁর মা–বাবার সঠিক পরিচর্যা, উৎসাহ ও সুযোগ দেওয়ার ফলেই তিনি অটিজমকে জয় করেছেন।

প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে ১০ হাজার শিশুর মধ্যে ১৫ জন শিশু অটিজমে আক্রান্ত। যেহেতু এটি একটি স্নায়ু বিকাশগত সমস্যা, ভবিষ্যতে এর সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে। তাদের সমাজের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে।

আমি মনে করি, অটিজম আক্রান্ত শিশুরা দেশের বোঝা নয় বরং সম্পদ। তাদের সঠিক পরিচর্যা করতে হবে ও ভালোবাসতে হবে। তাদের সব ক্ষেত্রেই অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। সমাজের সব মানুষকে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের সঙ্গে মেলামেশা করতে হবে। তাহলে তারা নিজেদের স্বাভাবিক ভাবতে শুরু করবে এবং তারাও দেশের উন্নয়নে অংশীদার হবে।

শরিফুল ইসলাম

শিক্ষার্থী

শেরপুর সদর, শেরপুর