সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কতটা যৌক্তিক

নীলক্ষেতে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, ২৭ আগস্ট, ২০২৩
ছবি

২০১৭ সালে ঢাকার স্বনামধন্য সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়, যা আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তির পর থেকেই বিভিন্ন সংকটের সৃষ্টি হয়েছে এবং তা নিরসনের চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ। তবে কিছু সমস্যা কাঁটার মতো এতটাই বিঁধে গিয়েছে যে, অধিভুক্তির প্রায় ৬ বছর শেষ হতে চললেও সংকট কাটেনি। শুক্রবার নীলক্ষেত মোড়ে বিভিন্ন সংকট নিরসনের জন্য আন্দোলন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা।

অনেকগুলো দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো, যেসব শিক্ষার্থী তিন বিষয় পর্যন্ত অকৃতকার্য হয়েছে তাদের মানোন্নয়নের সুযোগ দিয়ে পরবর্তী বর্ষে ভর্তি হতে দিতে হবে। অনেকেই বিষয়টিকে অযৌক্তিক এবং হাস্যকর হিসেবে দেখছেন। কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে বিভিন্ন গুরুতর সমস্যা বিদ্যমান এখানে।

দ্বিতীয় বর্ষের (২০১৯-২০ সেশন) চূড়ান্ত পরীক্ষা হয়েছে গত বছর। অথচ অর্থনীতি বিভাগের সেই পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে গত ২৮ জুলাই, ২০২৩ তারিখে। অর্থাৎ পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার সাত থেকে আট মাস পরে একজন শিক্ষার্থী জানতে পেরেছে যে, তিনি পরবর্তী বর্ষে যেতে পারছেন কি পারছেন না। ঠিক তার পাঁচ দিনের মাথায় অর্থাৎ, ২ আগস্ট তৃতীয় বর্ষের ফরম পূরণের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এখন যে শিক্ষার্থী বিগত ৭ থেকে ৮ মাস তৃতীয় বর্ষের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার পরে জানতে পারলেন যে, তিনি আসলে তৃতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হননি, তার এই দীর্ঘ সময়ের পরিশ্রম নষ্ট হয়ে গেল। কারণ তাঁকে আবার দ্বিতীয় বর্ষেই থাকতে হবে এবং নতুন করে দ্বিতীয় বর্ষের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।

ঠিক এখানে এসেই শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করতে শুরু করেন যে, আমাদের এখন অকৃতকার্য হওয়া কোর্সগুলোতে মানোন্নয়ন পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দিয়ে পরের বর্ষে যেতে দিতে হবে। অনেক সময় যে অযৌক্তিক দাবি থাকে না সেটা আমি বলছি না। কিন্তু বিলম্বে ফল প্রকাশের বিড়ম্বনা থেকে বের হওয়া না গেলে এই আন্দোলনের সমস্যা কখনোই সমাধান করা সম্ভব নয়।

এ ছাড়াও সাত কলেজের ফলাফল বিপর্যয় বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করছে। বর্ষভিত্তিক একটি চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের উপর অনেক বেশি চাপ তৈরি হয়। যেকারণে অনেক শিক্ষার্থী ভালো ফলাফল করতে পারেন না। পাশাপাশি পরীক্ষার রুটিন প্রণয়নেও কিছু সমস্যা রয়েছে। নেই কোনো একাডেমিক রুটিনও।

আগামী ৭ সেপ্টেম্বর থেকে আরম্ভ হতে যাওয়া তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা ২৮ আগস্ট স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। এই পরীক্ষার রুটিনে এক একটি কোর্সের পূর্বে মাত্র দুই দিন বন্ধ রাখা হয়েছিল। বর্ষভিত্তিক পরীক্ষায় দুই দিনে একটি কোর্সের রিভিশন সম্পন্ন করা প্রায় অসম্ভব বলা যায়। এর ফলে যথেষ্ট প্রস্তুতি নেওয়া সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে ভালো ফল পায় না।

বিশ্ববিদ্যালয় বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নের জন্য। যেমন: ৭৫% উপস্থিতি না থাকলে নন-কলেজিয়েট (জরিমানা প্রদান সাপেক্ষে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে), ৬০% না থাকলে ডিস-কলেজিয়েট (পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অযোগ্য বিবেচিত হবে), প্রমোশনের জন্য ন্যূনতম জিপিএ/সিজিপিএ পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার শর্ত, পাশ করা শিক্ষার্থীদের একবারের বেশি মানোন্নয়ন পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ না দেওয়া, মানোন্নয়ন পরীক্ষা দিতে চাইলে পরবর্তী দুই বছরের মধ্যেই দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ইত্যাদি।

এসব অবশ্যই ভালো পদক্ষেপ। অনেকেই জিপিএ শর্ত শিথিল করার কথা বলেন। কিন্তু এমন কোনো কঠিন শর্ত দেওয়া হয়নি যা শিক্ষার্থীদের জন্য কষ্টসাধ্য। অনুষদভেদে সর্বোচ্চ ২.৫০ সিজিপিএ শর্ত দেওয়া হয়েছে। কিছু অনুষদে আরও শিথিলতা রয়েছে। ন্যূনতম এতটুকু ফলাফলে উত্তীর্ণ না হলে তেমন কোনো মূল্য পাওয়া যায় বলে আমার মনে হয় না। তাই এই শর্ত শিথিল করার জন্য আন্দোলন করা খুব বেশি যৌক্তিক নয়।

তবে বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রথমত, নন-কলেজিয়েট এবং ডিস-কলেজিয়েট বিষয়টির দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এক মাস অন্তর অন্তর অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের নোটিশ দিয়ে ডেকে এনে সতর্ক করতে হবে এবং ক্লাসমুখী হওয়ার জন্য পরামর্শ দিতে হবে। তাহলে এই শিক্ষার্থীরা আর আন্দোলনে আসার যৌক্তিক কোনো কারণ খুঁজে পাবে না। কিন্তু শুধু ফরম পূরণের সময়ে এসে এই বিষয়টি নিয়ে চাপ প্রয়োগ করলে শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে রাস্তায় নেমে আসবে এটা অস্বাভাবিক নয়।

দ্বিতীয়ত, বর্ষভিত্তিক ব্যবস্থার পরিবর্তে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করতে হবে। তাহলে বছর শেষে শিক্ষার্থীদের উপর পড়াশোনার চাপ বৃদ্ধি পাবে না। বরং ছয় মাস অন্তর অন্তর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে তারা ভালো ফলাফল করতে সক্ষম হবে। তখন একবারে সম্পূর্ণ কোর্সের উপর পরীক্ষায় বসার দুশ্চিন্তা থাকবে না এবং ফলাফল বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব হবে।

তৃতীয়ত, দ্রুত সময়ের মধ্যে পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে হবে। তা না হলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষার সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়ন করা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনয়নের জন্য প্রয়োজন যেসব পরীক্ষার্থী চ্যালেঞ্জ করেন তাঁদের খাতার মূল্যায়ন তাঁদের সামনে করতে হবে এবং সেটা প্রচার করতে হবে। তাহলে অযথা খাতা চ্যালেঞ্জ করা বন্ধ হয়ে যাবে। কোনো শিক্ষকের খাতা মূল্যায়নে ত্রুটি থাকলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।

এ ছাড়াও যেসব ছাত্রনেতারা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন তাদের নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে। যেমন: একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রণয়ন, দ্রুত ফল প্রকাশ, সেমিস্টার পদ্ধতির প্রবর্তন, নিয়মিত ক্লাস করানো, পরীক্ষার্থীদের প্রস্তুতির কথা মাথায় রেখে রুটিন প্রণয়ন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে পরিকল্পনা মাফিক আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করতে হবে। এতে করে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান মিলবে। শুধু ফরম পূরণের সময়ে আন্দোলন করে বিচ্ছিন্ন কিছু সমস্যা সমাধান হলেও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা থেকেই যাবে। পাশাপাশি আপনারা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগী হতেও সচেতন করতে পারেন। তাহলে শিক্ষার্থীরা পাঠকক্ষে ফিরে যাবে এবং সমস্যার সমাধান মিলবে আরও সহজে।

মো. শাহাদাত হোসাইন
গণিত বিভাগ, তৃতীয় বর্ষ
ঢাকা কলেজ