পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজি কোর্স নার্সিংয়ের সমান হতে পারে না

মানবসেবার অন্যতম এক পেশার নাম নার্সিং, যাকে নোবেল প্রফেশনও বলা হয়ে থাকে। যুগ যুগ ধরে নার্সরা তাঁদের সেবা দিয়ে অসংখ্য অসুস্থ প্রাণকে সুস্থতায় ফিরিয়ে আনতে অসাধারণ ভূমিকা রেখে আসছেন। কিন্তু এই মহৎ পেশাটি আজও অবহেলিত।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নার্সিং পেশা নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি রোগী হয়ে দেখেছি, ঘুরে দেখেছি। আমাদের নার্সিং যেন আমাদের সমাজের জন্য একটি অসম্মানজনক পেশা। আমি বুঝতে পারি না এ সমাজ কী করে বাঁচবে? একটা মেয়ে দেশের খাতিরে নার্সের কাজ করছে, তার সম্মান হবে না আর ভালো কাপড়চোপড় পরে যারা ঘুরে বেড়াবে তার সম্মান হবে অনেক উচ্চে, চেয়ারখানা তাকেই দেওয়া হবে। এরও একটা মান থাকতে হবে। আমি ডাক্তার সাহেবদের সাথে পরামর্শ করেছিলাম যে আপনারা আমাকে একটা প্ল্যান দেন, যাতে আইএ পাস ও গ্রাজুয়েট মেয়েরা এখানে আসতে পারে।’

বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন পূরণে তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রয়াসে নার্সিং পেশায় অনেক ধরনের উন্নতি লক্ষণীয়। এখন নার্সরা বাংলাদেশেই পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণ করতে পারেন। নার্সিং শিক্ষায় আসতে হলে এইচএসসিতে নির্দিষ্ট জিপিএ থাকতে হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষার মতোই ভর্তিযুদ্ধ নার্সিংয়েও হয়। পাস করতে হলে প্রয়োজন সর্বনিম্ন ৪০ নম্বর। এতে ভর্তির সুযোগ না পেলেও কোনো বেসরকারি নার্সিংয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা থাকবে। আর সরকারিতে সুযোগ পাওয়ার জন্য ৮০ নম্বর পেয়েও শোনা যায় সরকারি নার্সিং কলেজে সিট না পাওয়ার আর্তনাদ।

শুধু ভর্তির আগেই নয়, যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয় ভর্তির পরও। পড়াশোনার জন্য কাটাতে হয় কতশত নির্ঘুম রাত, পাশাপাশি থাকে হাতেকলমে শিক্ষার জন্য হাসপাতালে ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিস, ল্যাব ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, ফিল্ড ভিজিট। লিখিত, মৌখিক ও ব্যবহারিকে করতে হয় আলাদাভাবে পাস। লিখিত পরীক্ষায় পেতে হয় ১০০–এর মধ্যে সর্বনিম্ন ৬০ নম্বর। সবকিছুই পড়তে হয় ইংরেজি মাধ্যমে, যেমনটা মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়। বিএসসি নার্সিংয়ে ৪ বছর ও ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারিতে ৩ বছর মেয়াদি কোর্স সম্পন্ন করার পর ৬ মাসের ইন্টার্নি করতে হয়, তারপর আবার দিতে হয় লাইসেন্সিং পরীক্ষা। কিন্তু এত ত্যাগ শিকার ও উন্নতির পরও কিছু অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের কারণে এ পেশাটির মান আবার ঝরে যেতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশে এ পেশাটি তুমুল ঝুঁকিতে রয়েছে।

গত ২ এপ্রিল ২০২৩–এ স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপনে ৩ বা ৪ বছর মেয়াদি পিসিটি বা ডিপ্লোমা ইন পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজি কোর্সকে ৩ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারির সমান মান প্রদান করে, যা সম্পূর্ণই একটি অযৌক্তিক কার্যক্রম।

হ্যাঁ, পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিও মানবসেবার পেশা, আমরা এ পেশাকে সম্মান জানাই। তবে অযৌক্তিক প্রজ্ঞাপন মেনে নেওয়া মানে নার্সিংয়ের সর্বনাশ ডেকে আনা। কারণ, পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজি ও নার্সিংয়ের মধ্যে রয়েছে বড় ধরনের তফাত। যেখানে এইচএসসির পর নানা যুদ্ধের সম্মুখীন হয়ে একজন নার্স হতে হয়, বেসরকারি একটি নার্সিং কলেজে পড়তে হলে ঢালতে হয় লাখ লাখ টাকা। সেখানে এসএসসির পরই যে কেউ ভর্তি হতে পারেন পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজি কোর্সে। এমনকি নার্সিংয়ের মতো পড়ালেখা বা নার্সিং সমমান টাকাও তাঁদের খরচ করতে হয় না।

বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের অধীন পরিচালিত এ কোর্সটি কখনোই ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কোর্সের সমান হতে পারে না। তাই একটি অযৌক্তিক প্রজ্ঞাপন জারি করায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। আর শিগগিরই এমন নোটিশের বিরুদ্ধে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে নার্সিং পেশা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

হালিমা বিবি
শিক্ষার্থী
ইবনে সিনা নার্সিং ইনস্টিটিউট, কল্যাণপুর, ঢাকা।