বাল্যবিবাহ নারীর অগ্রযাত্রায় বড় বাধা

বাল্যবিবাহ হচ্ছে অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক বিবাহ। এটি এমন বিবাহ, যার কোনো এক পক্ষ বা উভয় পক্ষ অপ্রাপ্তবয়স্ক। অর্থাৎ যখন ২১ বৎসর পূর্ণ করেননি এমন কোনো পুরুষ কিংবা ১৮ বৎসর পূর্ণ করেননি এমন কোনো নারী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখন তা বাল্যবিবাহ হিসেবে গণ্য হয়।

ব্রিটিশ ভারত ১৯২৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম বাল্যবিবাহ নিরোধক আইন পাস করে। এই আইনে উল্লেখ আছে যে মেয়েদের জন্য বিয়ের বয়স ১৪ বছর এবং ছেলেদের জন্য বিয়ের বয়স ১৮ বছর। পরবর্তীকালে আমাদের দেশে সেই বয়সসীমা বাতিল করে মেয়েদের জন্য ১৮ বছর এবং ছেলেদের জন্য ২১ বছর করা হয়েছে।

বাল্যবিবাহ নিরোধ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ সালে ব্রিটিশ আইন বাতিলপূর্বক সময়োপযোগী করে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭’ নামে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করে। এই আইনে বলা হয়েছে, বাল্যবিবাহসংশ্লিষ্ট মাতা–পিতাসহ অন্যান্য ব্যক্তিকেও এই আইনের আওতায় আনা যাবে এবং বাল্যবিবাহ সম্পাদনকারী বা পরিচালনাকারীও অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন।

বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৩-এর প্রতিবেদনে ২০০৬ থেকে ২০২২ সালের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে যে বয়স ১৮ হওয়ার আগেই বাংলাদেশের ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ১৫ বছর বা তার কম বয়সী মেয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিয়ের হার ২৭ শতাংশ। কিন্তু গ্রামীণ এলাকায় বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে বেশি। অনেক গ্রামীণ এলাকায় শতকরা ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশই বাল্যবিবাহ হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৭৪টি শিশুর জন্ম দিচ্ছেন ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মায়েরা। বাল্যবিবাহের কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা, মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি, অপরিণত গর্ভধারণ, প্রসবকালীন শিশুর মৃত্যুঝুঁকি, প্রজনন স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যা, নারীশিক্ষার হার হ্রাস, স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হারের বৃদ্ধি ঘটছে। নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষমতা ও সুযোগ কমে যাওয়াসহ নানা ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কাও থাকে।

মেয়েদের অপ্রাপ্তবয়সে বিয়ে হওয়ার ফলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। তাদের অল্প বয়সে পড়ালেখা ছেড়ে অন্য একটি নতুন পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়। দূরে সরে যায় তার স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন। অনেককে সহ্য করতে হয় শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা। কিন্তু একজন মেয়ে যদি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে পড়ালেখা শেষ করে বিবাহ সম্পন্ন করে, তাহলে সে স্বাবলম্বী হতে পারে, আত্মনির্ভরশীল হতে পারে। নানা পারিবারিক গঞ্জনা বা নিপীড়নও সহ্য করতে হবে না। ফলস্বরূপ হ্রাস পেতে পারে নারী নির্যাতন।

বিশ্বে বাল্যবিবাহের শীর্ষে রয়েছে আফ্রিকার দেশ নাইজার (৭৬%)। এরপর যৌথভাবে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র ও চাদ (৬১%)। এরপর রয়েছে মালি (৫৪%), মোজাম্বিক (৫৩%) ও দক্ষিণ সুদান (৫২%)। বাল্যবিবাহে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে বাংলাদেশ এবং বিশ্বে অষ্টম বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম বাল্যবিবাহ ঘটে মালদ্বীপে, মাত্র ২ শতাংশ। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কায় ১০, পাকিস্তানে ১৮, ভারতে ২৩, ভুটানে ২৬, আফগানিস্তানে ২৮ এবং নেপালে ৩৩ শতাংশ বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটে। বাল্যবিবাহ নেই সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, বেলজিয়াম, লিথুয়ানিয়া, যুক্তরাজ্য ও উত্তর আয়ারল্যান্ডে।

সরকারের জাতীয় কর্মপরিকল্পনা অনুসারে ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের কমবয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহ এক-তৃতীয়াংশ কমানোর লক্ষ্য ছিল। আর ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি নির্মূলের অঙ্গীকার রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, বাল্যবিবাহ রোধ করার প্রধান উপায় হলো নারীদের শিক্ষা অর্জন, বিবাহের ন্যূনতম বয়সসংক্রান্ত আইনের বাস্তবায়ন এবং অভিভাবকদের বাল্যবিবাহের ঝুঁকি সম্পর্কে অবগত করা। বাল্যবিবাহরোধে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্যবিবাহেরকি সম্পর্কে সচেতন করা, সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিরপরিবর্তন, নারীশিক্ষা বৃদ্ধিকরণ এবং নারী ও তার পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করা।

প্রীতম দাস
শিক্ষার্থী
সিলেট সদর, সিলেট।