পৃথিবীতে কালে কালে অনেক মহামারি এসেছে এবং তার থেকে মানুষের মুক্তিও মিলেছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে পরিবেশকে দূষিত করে আমরা পৃথিবীকে বসবাসের অযোগ্য করে ফেলছি, তার থেকে মনে হয় খুব সহজে পরিত্রাণ মিলবে না।
বিশ্বজুড়ে বছরের পর বছর ধরে চলছে পরিবেশদূষণের মহামারি। এই মহামারির কবে মুক্তি ঘটবে, সেটি এই পৃথিবীর কেউ জানেন না। হাজার বছর আগের সেই সবুজ পৃথিবী এখন আর নেই। দূষণের কালো চাদরে ঢেকে গেছে পুরো পৃথিবী। দূষণের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। উন্নত জীবনযাপনের জন্য অতিরিক্ত নগরায়ণ করতে গিয়ে বেঁচে থাকার ভিত্তি পরিবেশকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলছে মানুষ।
আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হলো পরিবেশ। পরিবেশদূষণের সবচেয়ে বড় কারণ হলো নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও বনভূমি উজাড়। নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে পরিবেশ আজ হুমকির মুখে পড়েছে।
পরিবেশদূষণের কারণে মানুষ বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, যেমন ক্যানসার, শ্বাসকষ্ট, পানিবাহিত রোগ ইত্যাদি। জীবজন্তুর আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। অনেক জীবজন্তু পরিবেশ থেকে বিলুপ্ত হচ্ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে।
উপকূলীয় অঞ্চলে অতিরিক্ত লোনা পানি ঢোকার কারণে খাওয়ার পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। খাবারে যতটুকু লবণ থাকা উচিত, তার তুলনায় অনেক গুণ বেশি লবণ খাবারের সঙ্গে গ্রহণ করছেন উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ। এতে এ অঞ্চলের নারীদের গর্ভপাতের হার বেড়ে গেছে। আর প্রতিবছর বিভিন্ন সময়ে হওয়া ঘূর্ণিঝড়, বন্যার কারণে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দুঃখের শেষ নেই।
জাতিসংঘের পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, পরিবেশদূষণের ফলে এশিয়ার আকাশে তিন কিলোমিটার পুরু ধোঁয়াশা জমেছে, যা অ্যাসিড বৃষ্টি ঘটাতে পারে। এটা পৃথিবীতে বসবাসকারী সব প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য ক্ষতিকর।
মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে উৎপাদিত ক্ষতিকর পদার্থ যেমন গ্রিনহাউস গ্যাস, ইগজোস্ট গ্যাস, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, শিল্পকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য, আর্সেনিকযুক্ত বর্জ্য, পারদ, সিসা, বালাইনাশক, আগাছানাশক, ধোঁয়া ইত্যাদি মারাত্মকভাবে পরিবেশদূষণ করছে। গ্রিনহাউস গ্যাসের ফলে বায়ুমণ্ডলের তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, গ্রিনহাউস ইফেক্টের কারণে তাপ বৃদ্ধির ফলে খুব তাড়াতাড়ি মেরু অঞ্চলের ও পর্বত শ্রেণির বরফ গলে সাগরের উচ্চতা এক থেকে দুই মিটার বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে পৃথিবীর অধিকাংশ ও উপকূলীয় অঞ্চল সমুদ্রের লোনা পানির নিচে ডুবে যাবে। কোটি কোটি মানুষের খাদ্যের সংকট দেখা দিবে।
পরিবেশ চরমভাবে দূষিত হচ্ছে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও বনভূমি ধ্বংসের কারণে। বনভূমিই সমগ্র পৃথিবীকে টিকিয়ে রেখেছে। পরিবেশ রক্ষার জন্য দেশের শতকরা ভূমির ২৫ শতাংশ বনভূমি দরকার। দেশে কাগজে-কলমে ১৭ শতাংশ থাকার কথা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে তা ৮ থেকে ১০ শতাংশের বেশি নয়। প্রতিবছর ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বসতি স্থাপন এবং শিল্পায়নের ফলে ১ শতাংশ হারে আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস ও ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ বন নিধন হচ্ছে। প্রতি মিনিটে ২১ হেক্টর কৃষিজমি বন্ধা হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর ৭৫ লাখ হেক্টর জমি মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। প্রতি মিনিটে ৫০ হেক্টর জমি বালুকাকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের দেশের রক্ষাকবচ হলো সুন্দরবন। সেই সুন্দরবনের গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। সুন্দরবনের পাশে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হয়েছে। যতই বলা হোক তাতে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না, কিন্তু ক্ষতি অবশ্যই হচ্ছে। দেশকে এভাবে এগিয়ে নিয়ে কি লাভ, যদি পরিবেশই নষ্ট হয়ে যায়? চাইলে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের অন্য কোথাও তৈরি করা যেত। কিন্তু সুন্দরবন ধ্বংস হলে তা কি আর দেশের কোথাও তৈরি করা যাবে? আমরা নিজ হাতে আমাদের বেঁচে থাকার সম্বল নষ্ট করে দিচ্ছি। প্রতিবছরই কোনো না কোনো সময় ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশের ওপর আঘাত হানে। কিন্তু আমাদের রক্ষাকবচ সুন্দরবন তা প্রতিহত করে আমাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে দেয়। আর আমরাই সেই রক্ষাকবচকে ধ্বংস করছি।
এখনই পরিবেশদূষণ রোধ না করতে পারলে একসময় পৃথিবীর মানচিত্রই বদলে যাবে।
পরিবেশদূষণ রোধে জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। যে মাত্রায় পরিবেশদূষণ হচ্ছে, তাতে পৃথিবী ধ্বংসের দোরগোড়ায় চলে এসেছে। তাই পরিবেশদূষণ রোধে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। গণমাধ্যমে এ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচার–প্রচারণা চালাতে হবে। সুন্দরবন রক্ষায় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, ধ্বংসের মুখে পতিত পরিবেশকে রক্ষা করে পৃথিবীকে মানুষের বাসপোযোগী করতে পারে একমাত্র গাছ।
সুকান্ত দাস
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া