উচ্চশিক্ষিত হয়েও কেন তরুণেরা বেকার

বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই তরুণ। এ দেশের কর্মসংস্থানেও তারুণ্যের ভূমিকা অসামান্য। স্বাধীনতার পর প্রায় সব খাতেই এগিয়েছে দেশ, বাড়ছে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতিও। তবে শিক্ষার হার বাড়লেও বাড়ছে না কর্মসংস্থানের।

প্রতিবছর নতুন নতুন মুখ যুক্ত হচ্ছে বেকারত্বের ঘরে। বর্তমান তরুণসমাজের বড় অংশই বেকার, অনিশ্চিত জীবনের পথে। কোনো দেশের জনশক্তির তুলনায় কর্মসংস্থানের স্বল্পতার ফলে সৃষ্ট সমস্যাই বেকার সমস্যা। বাংলাদেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নের পথে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, বেকার সমস্যা এর মধ্যে অন্যতম।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) একটি প্রতিবেদনে বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলো থেকে বের হওয়া শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশই বেকার, অর্থাৎ ৩ ভাগের ২ ভাগই বেকার থাকছেন। মাত্র ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী অন্য কোনো বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী নিজের উদ্যোগে কাজ করছেন।

অন্য একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জন করা ৪৭ শতাংশ শিক্ষার্থীই বেকার থাকছেন।

ভারতে এই হার মাত্র ৩৩, পাকিস্তানে ২৮, নেপালে ২০ আর শ্রীলঙ্কায় মাত্র ৭ দশমিক ৮। এতেই বোঝা যায়, আমাদের দেশ থেকে আমাদের প্রতিবেশী দেশের বেকারত্বের হার কত কম।

বর্তমানে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখের বেশি। এর মধ্যে শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই বেশি। বিভিন্ন সংস্থার জরিপে উঠে এসেছে, বছরে চাকরিপ্রত্যাশী প্রায় ২০ লাখ মানুষ। কিন্তু কাজ না পাওয়ায় বাড়ছে দিন দিন বেকার সমস্যা। আমাদের দেশে সরকারি–বেসরকারি—দুই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাই বেড়েছে। কিন্তু কর্মক্ষেত্র না বাড়ায় উচ্চশিক্ষা শেষে বেকারদের সংখ্যাও বাড়ছে।

বাংলাদেশের দুটি খাতে চাকরির সুযোগ বেশি রয়েছে, একটি হলো কৃষি খাত, অন্যটি হলো উৎপাদনশীল। এই দুই খাতে কারিগরিভাবে দক্ষ লোকের চাহিদা অনেক বেশি, শিক্ষিত বেকারদের থেকে। একটা সময় এমন ছিল যে আমাদের শিক্ষিত তরুণেরা ভালো বেতনের আশায় বেসরকারি চাকরির প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন।

কিন্তু গত কয়েক বছরে সরকারি চাকরিতে এত বেশি পরিমাণে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে যে এখন তরুণেরা অধিকাংশ সময় সরকারি চাকরির প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছেন। প্রতিবছর ১ দশমিক ১ শতাংশ পুরুষ এবং ১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ নারী নতুন করে বেকারত্বের খাতায় নাম লেখাচ্ছেন। মূলধারার অর্থনীতিতে অবদান রাখতে অনেকটাই পিছিয়ে বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থীরা।

বাংলাদেশের মতো সীমিত সম্পদের দেশে একটি শিশুর জন্ম থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জন পর্যন্ত পিতা–মাতাকে অপরিসীম ত্যাগের পাশাপাশি অনেক সম্পদও ব্যয় করতে হয়। এত কাঠখড় পোড়ানোর পরও যখন বেকারত্বের গ্লানি বয়ে বেড়াতে হচ্ছে একজন উচ্চশিক্ষিত তরুণের, তখন হতাশার ছায়া নেমে আসে পুরো পরিবারের ওপর। আজকাল প্রায়ই দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা। যার পেছনে কারণ হিসেবে থাকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দুশ্চিন্তা ও স্বপ্নভঙ্গের ঘটনা।

বর্তমানে চাকরির বাজারে চাহিদার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা সংগতিপূর্ণ না হওয়ায় শিক্ষিত বেকার বেড়েই চলেছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করতে পারছে না।

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে পড়াশোনা করেও প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাবে অনেকেই বেকার থেকে যাচ্ছেন। এই দক্ষতার ঘাটতি দেশকে শ্রমশক্তিতে পিছিয়ে দিচ্ছে।

বেকারত্ব যেকোনো দেশের জন্য অভিশাপস্বরূপ। শিক্ষিতদের একটি বড় অংশ কর্মহীন হলে দেশের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিও পিছিয়ে থাকবে, অর্থনীতির চাকা হঠাৎ উল্টো ঘোরা শুরু করবে, দারিদ্র্যের সংখ্যা বাড়বে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পথ কালো মেঘে ঢেকে যাবে। তাই এখনই সময়, শিক্ষিত বেকারের প্রতি নজর দেওয়া এবং তাঁদের উপযুক্ত কর্মসংস্থান তৈরি করে দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি সচল করা।

আইরিন হাসান
ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেৃজমেন্ট, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া