হারিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের বর্ষার ফল কাউ

কাউফল

এবার ঈদের ছুটিতে মামাবাড়ি গিয়ে গ্রামের পথ ধরে হাঁটার সময় চোখ পড়ে মেঠো পথে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কমলালেবুর আকৃতির এক ফলের ওপর। গাছের ডগায় তাকিয়ে দেখি, ফলের ভারে ডালপালাগুলো নুয়ে পড়েছে। আর পাকা ফল রাস্তায় বিছিয়ে পড়ে কেমন কমলা বর্ণ ধারণ করেছে। পাশে থাকা মামাতো বোনের থেকে জানলাম, এর নাম কাউফল, খানিকটা টক-মিষ্টি স্বাদের।

শুধু স্বাদে নয়, পুষ্টিগুণেও এগিয়ে এই ফল, যা ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ এবং মুখের অরুচি দূর করে। পরিমিত ক্যালোরিসমৃদ্ধ চর্বি, ফাইবার ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকায় শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, বিকাশ ও রোগপ্রতিরোধে এই ফলের প্রয়োজনীয়তা অনেক। সর্দি-জ্বর ও ঠান্ডা সারায়। গাছের ছাল আমাশয়, খিঁচুনি ও মাথাব্যথায় উপকারী।

এই ফলে কপার, ফাইবার, ম্যাঙ্গানিজ ও প্রচুর পটাশিয়াম থাকায় হাড় মজবুত রাখে, হৃৎস্পন্দনে সাহায্য করে। এতে থিয়ামিন, নিয়াসিন ও ভিটামিন বি-কমপ্লেক্সসহ আরও প্রয়োজনীয় উপাদান থাকায় রক্তচাপ, স্ট্রোক ও করোনারি হার্ট রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়। অপুষ্টিজনিত সমস্যায় উপকারী কাউফল। অনেকে পাতার রস চুলের খুসকি দূর করতে ব্যবহার করেন।

লবণ, মরিচের গুঁড়া দিয়ে পাকা ফলের ভর্তা খেতে দারুণ সুস্বাদু। অনেকে আবার ছোট মাছের তরকারিতে কাউফল ব্যবহার করেন। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীরা সবজি হিসেবে কাউয়ের পাতা খেয়ে থাকেন। অপরিপক্ব ফল দিয়ে চাটনি তৈরি করেন। কষ দিয়ে রং, রজন ও বার্নিশ তৈরি হয়। ইঁদুর ও পাখির অতি প্রিয় এই কাউফল।

বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চল শরীয়তপুর, পিরোজপুর, বরিশাল, বাগেরহাট, পটুয়াখালী অঞ্চলের জঙ্গলে, খালের পাড়ে দেখা মেলে কাউগাছের। বাংলাদেশের মাটি, জলবায়ু, আবহাওয়া, প্রকৃতি দেশীয় ফল উৎপাদনে অত্যন্ত সহায়ক। আমাদের গ্রামাঞ্চলে রোপণ না করা সত্ত্বেও অসংখ্য দেশি ফলের গাছ আপনা-আপনি জন্মে। এ দেশের মাটি উর্বর হওয়ায় উৎপাদনের প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও একে একে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এসব দেশি ফল। একটি জরিপ অনুযায়ী, মাত্র দুই যুগ আগেও দেশে প্রধান ও অপ্রধান মিলিয়ে শতাধিক জাতের দেশি ফল পাওয়া যেত। বর্তমানে এর সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে অর্ধশতে।

যেসব দেশি ফল বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে—গোলাপজাম, শরিফা, চালতা, সাতকরা, জামির, জাম্বুরা, বিলম্ব, গাব, তুঁতফল, চাম্পাকলা, জামরুল, তাল, বেতফল, তৈকর, বকুল, ডেউয়া, পানিফল, খেজুর, অরবরই, লুকলুকি, চুকুর, প্যাসনফল, আঁশফল, মাখনা, ফসলা, কাউফল, করমচা, মুনিয়া, ডেফল, চাম্বুল প্রভৃতি। আগামী এক যুগ পর এসব দেশি ফল হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

দেশের বিশিষ্ট ফলবিজ্ঞানী, ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবদুর রহিম জানান, গত দুই দশকের মধ্যে দেশি ফলের মধ্যে প্রায় অর্ধেক বিলুপ্তির পথে। কাগজপত্রে বর্তমানে ৫৫ জাতের দেশীয় ফল চিহ্নিত করা হলেও বাস্তবে দেশীয় ফলের অস্তিত্ব রয়েছে ৩৯টি। এ থেকে উত্তরণ প্রয়োজন। নতুবা একসময় দেশীয় ফল আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে যাবে। তিনি জানান, দেশীয় ফল উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফলের বাজার দখল করে নিয়েছে আপেল, আঙুর, বেদানা, স্ট্রবেরি, নাশপাতি, ড্রাগন, অ্যাভোকাডো প্রভৃতি আমদানি করা বিদেশি ফল। আমদানি করা ফলে ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থমিশ্রিত বলে এসব খেয়ে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। এ থেকে পরিত্রাণে বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি দেশীয় ফলের উৎপাদন ও সম্প্রসারণে কৃষি বিভাগকে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া দরকার বলে মনে করেন।

আমাদের বেশি করে দেশি ফলের গাছ রোপণ করা আবশ্যক। এতে সবুজায়ন হবে দেশ এবং মানুষের কম দামে ভিটামিন ও পুষ্টির চাহিদা মিটবে। সেই সঙ্গে নিরসন হবে অর্থনৈতিক সংকটও।

আফসানা আক্তার
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: [email protected]