বাংলাদেশের বেসরকারি বা আধা সরকারি শিক্ষকদের দুঃখ–কষ্টের কথা শোনার মতো কে আছে? শিক্ষকদের আর্থিক দুর্দশার কথা বোঝার মতো কে আছে? কে বুঝতে চায় শিক্ষকদের মন?
বর্তমানে দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষকদের নিয়োগ সুপারিশ দিচ্ছে সরাসরি সরকার এনটিআরসিএর মাধ্যমে। এরপরও শিক্ষকেরা ‘ফুল গভর্নমেন্ট’ বলে নিজেদের পরিচয় দিতে পারেন না। একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক সরকারের তরফ থেকে সাকুল্যে বেতন পাচ্ছেন একজন সমস্কেলের সরকারি চাকরিজীবীর অর্ধেক বা অর্ধেকের একটু বেশি। এতে কী বোঝা যায়? বোঝা যায়, তাহলে একজন শিক্ষককে সরকার মূল্যায়ন করছে কি অর্ধেক মানুষ হিসেবে? তাহলে কি একজন শিক্ষক ও তাঁর পরিবারবর্গের পেটের ক্ষুধাও কি অর্ধেক? আর সামাজিক সম্মানের ক্ষেত্রেও কি সরকারি চাকরিজীবীরা বা অন্য কোনো পেশাজীবীরা শিক্ষকদের কি অর্ধেক মানুষ হিসেবে দেখে কি? সে চিন্তা আজ দেশের মানুষকে করতে হবে।
শিক্ষকদের দুঃখ–কষ্টের কথা দেশের সাধারণ মানুষ, ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদেরও উপলব্ধি করতে হবে, শিক্ষকদের পরিপূর্ণ অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সাধারণ মানুষেরও প্রতিবাদী হওয়ার সময় এসেছে। শিক্ষকেরা আসলে বড্ড একা হয়ে গেছেন, তাঁদের আত্মমর্যাদা ও অভিমানটা বড্ড বেশি বলে আন্দোলনটা সেভাবে জোরদার হয় না। ক্লাসে শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের সামনে যতটা সফল ও শক্তিশালী কিন্তু সত্যিকারের জীবনসংগ্রামে ও সংসারের আর্থিক নিরাপত্তাবিধানে তাঁরা ততটুকুই ব্যর্থ। শিক্ষকেরা ভেতরে–ভেতরে কতটা দুঃখ–দুর্দশায় থাকেন, সেটা কারও না জানলেও চলবে।
প্রকৃত শিক্ষকের আদর্শই হলো দিতে চাওয়া, নিতে চাওয়া নয়। বিষয়ভিত্তিক সঠিক জ্ঞান বিতরণ ও শিষ্টাচার-ভদ্রতা-নৈতিকতা-আদর্শ শেখানো তাঁদের কাজ কিন্তু নিজেদের বেতন–ভাতা বৃদ্ধির জন্য ও এ–সংক্রান্ত অনিয়মগুলোর বিরুদ্ধে কঠিন আন্দোলন–সংগ্রাম করা তাঁদের কাজ নয়, এ দায়িত্ব সমাজের শিক্ষানুরাগী বিবেকবান মানুষের। প্রকৃত শিক্ষকসমাজ বড্ড বেশি অভিমানী হয়, ছাত্রছাত্রীরা যত বড় অবস্থানেই যাক না কেন, আদর্শ শিক্ষকেরা কখনো ছাত্রছাত্রীর কাছে কোনো আর্থিক সাহায্য বা ক্ষমতার সহায়তা চাইতে পারেন না, ভেতরে লজ্জাবোধ ও আত্মমর্যাদা তাঁদের প্রবল থাকে। মা–মায়ের কাছে যেমন সন্তান কখনো বড় হয় না, তেমনি করে একজন শিক্ষকের কাছেও ছাত্রছাত্রী কোনো দিন বড় হয় না। শিক্ষক কি চায় জানেন? শিক্ষক চান ছাত্রছাত্রী বুড়ো হয়ে গেলেও যাতে জীবনের কোনো বিশেষক্ষণে যেন তাঁর মনপটে গভীর শ্রদ্ধা, ভক্তিতে ও ভালোবাসা সহকারে শিক্ষকের চেহারাখানা ভেসে ওঠে, সে মুহূর্তে সেই শিক্ষক পৃথিবীতে বেঁচে নাইবা থাকুক, তাতে কি! এখনেই শিক্ষকের মনের গভীরের চাপা অহংকার, হয়তো এ জায়গায়ই শিক্ষকের মানবজীবন ধন্য হয়।
একজন আদর্শ মানুষ, একটি জাতি, একটা দেশ ও একটি উন্নত নৈতিক কর্মময় জীবনব্যবস্থার জন্য শিক্ষকদের ভূমিকা যে কতখানি, তা একজন সাধারণ মানুষও গভীর চিন্তা করলে বুঝতে পারবেন। সমাজে শিক্ষকসমাজের গুরুত্ব কতটুকু, তা সে বিষয়ে এ লেখায় আলোচনা করতে চাই না, সেটা দেশ ও সমাজের মানুষই নিজ যোগ্যতায় উপলব্ধি করুক। শুধু বলতে চাই, বড় গাছ সবাই দেখে কিন্তু শিকড় থাকে মাটির তলে, অনেক উঁচু বিল্ডিং সবাই দেখে কিন্তু বিল্ডিংয়ের নিচের ফাউন্ডেশন দেখা যায় না। ছাত্রছাত্রীর বড় বড় সফলতার পেছনে শিক্ষকের অবদান ওই শিকড়ের মতো বা ওই ফাউন্ডেশনের মতোই।
আজকে যারা সমাজের একদম উঁচু পর্যায়ে আছেন, যেমন শিক্ষকতা চাকরির নীতিনির্ধারক, তাঁদের আজকের অবস্থানে আসার পেছনে কোনো না কোনো শিক্ষকের কোনো অবদান কি মোটেও নেই? কিন্তু সে শিক্ষকেরা সমাজে মূল্যায়িত হয় কতটুকু? সে বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। যতই উন্নত নৌকা বানান না কেন, মাঝির পেটে ক্ষুধা থাকলে সে নৌকা কতক্ষণ ভালো চলবে? স্পিডবোটও আছে, ইঞ্জিনও আছে কিন্তু ভালো চালককে সে রকম সুযোগ–সুবিধা না দিলে, ভালো চালক তো হারিয়ে যাবেনই।
একজন এনটিআরসিএর শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষাসহ নিয়োগপ্রক্রিয়ার বেশ কয়েকটি ধাপ সম্পন্ন করার পরে যখন কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় বা উচ্চবিদ্যালয়ে যোগদান করেন, তারপরেও কেউ বলতে পারবেন না কবে এমপিওভুক্ত হবেন। এমপিওভুক্তির যে প্রক্রিয়াটা বর্তমানে চালু আছে, তা অনেক ত্রুটিপূর্ণ, তা ভুক্তভোগীরা একবাক্যে স্বীকার করবেন। এমপিওভুক্তিকরণে পুরোপুরি নিরপেক্ষ একটা প্রক্রিয়া এখনো বাংলদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় চালু করা সম্ভব না করতে পারা মূলত বঙ্গবন্ধুর পরিপূর্ণ আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়ন পরিপন্থী বলেই আমার কাছে মনে হয়।
সবার কাছে আমার প্রশ্ন, এনটিআরসিএর মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েও একজন শিক্ষক কেন যোগদানের মাস শেষেই বেতনের সরকারি অংশ হাতে পাবেন না? যোগদানের কত মাস পরে বেতনের সরকারি অংশ হাতে পাবেন, সে বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা কেন থাকবে না?
মো. আসিফ উদ দৌলাহ্
ট্রেড ইনস্ট্রাক্টর
(কম্পিউটার অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি)
ভংগা কাদিরাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়
থানা: কাজিরহাট, উপজেলা: মেহেন্দিগঞ্জ
জেলা: বরিশাল