পর্যাপ্ত শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র এখন সময়ের দাবি

‘আমার তো এহন বয়স হইয়া গেছে, আমি আর এহন আগের মতো নাতি-নাতনির যত্ন নিতে পারি না মা। আর উনিও (উনার স্বামী) ঢাকায় আইয়া একা থাকতে থাকতে মাথায় সমস্যা হইয়া গেছে। এহন কী করমু মা, আমার ছেলেও তো পারে না’, বলছিলেন এক অসহায় দাদি।

এমন অহরহ আরও বহু ঘটনা পাওয়া যাবে দেশের আনাচকানাচে; যেখানে কর্মজীবী মায়েরা সব যান্ত্রিকতা পেছনে ঠেলে তাঁদের কর্মক্ষেত্রে গিয়েও তাঁর আদরের ছোট্ট সোনামণির জন্য হতাশা-উৎকণ্ঠায় থাকেন। অনেক সময় শিশুর দেখভালের জন্য বিশ্বস্ত কর্মীর অপ্রতুলতা বা পর্যাপ্ত দিবাযত্ন কেন্দ্রের অভাব হওয়ার কারণে নারীকে চাকরি পর্যন্ত ছেড়ে দিতে হয়। উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে ডে-কেয়ার সেন্টার বা দিবাযত্ন কেন্দ্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হিসেবে গঠন করা হলেও অনুন্নত-উন্নয়নশীল দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা উপেক্ষিত হয়; আর এই অবস্থার বলি হয় ‘আগামী দিনের কর্ণধার’—শিশুরা।

একটি শিশুর শারীরিক-মানসিক বিকাশ ও সামাজিকীকরণে একটি সুস্থ-সুন্দর-সুশীল পরিবেশের ভূমিকা, শিশুর জীবনে বাবা-মায়ের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। নগরায়ণের এই যুগে একক পরিবারের বিস্তারে যৌথ পরিবার এখন বিলুপ্তপ্রায়, তাই কর্মজীবী মায়েদের বা শিক্ষার্থী মায়েদের সন্তানেরা পায় না পর্যাপ্ত বিকাশক্ষেত্র। এ ক্ষেত্রে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র হতে পারে ভরসা ও আস্থার চারণভূমি।

বাংলাদেশে ১৯৯১ সাল থেকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর নিম্ন ও মধ্যম আয়ের কর্মজীবী নারীদের আর্থিক ক্ষমতায়নের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনা করছে। মন্ত্রণালয় সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, রাজস্ব খাত ও প্রকল্প থেকে অর্থায়নের মাধ্যমে মোট ১১৯টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। রাজস্ব খাতে থাকা ৪৩টি দিবাযত্ন কেন্দ্রের আসনসংখ্যা ২ হাজার ৮৩০।

তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি, যা বর্তমানে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। অধিকন্তু, বিদ্যমান কেন্দ্রগুলোর গুণগত মান, পরিবেশ ও সেবা নিয়েও রয়েছে অভিযোগ।

২০১৮ সালে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পরিচালনায় একটি সমীক্ষা করা হয়েছিল, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের ‘নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির কর্মজীবী মহিলাদের শিশুদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র কর্মসূচি’ শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে যে ১১টি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়, তার উদ্দেশ্য কতটুকু অর্জিত হয়েছে, তা অনুসন্ধানের জন্য।

সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, তখন সেবাগ্রহণকারী ২২০ জন কর্মজীবী নারী এবং অতীতে সেবা নেওয়া ৫৫ জন নারী উত্তরদাতার মধ্যে ৫৬ শতাংশ শিক্ষার মান এবং ৫৫ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছিলেন। শিশুরা জানিয়েছিল, ঘরে বন্দী থাকা, বয়সে একটু বড় শিশুদের হাতে প্রহারের শিকার হওয়া, টেলিভিশন নষ্ট থাকা, কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত ও শিক্ষকদের হাতে মার খাওয়া এবং একই ধরনের খাবারের কারণে তাদের খারাপ লাগা, কেন্দ্রের অধিকাংশ শিশুর প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতির দুর্বলতাসহ আরও নানা অনিয়মের কথা।

যেহেতু নারীর ক্ষমতায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো নারীর কর্মসংস্থান; সুতরাং তাঁদের সন্তানের জন্য সুস্থ-সুন্দর একটি পরিবেশ নিশ্চিত করাও পরিবার, সমাজ—তথা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

এ ক্ষেত্রে, দিবাযত্ন কেন্দ্রে বিদ্যমান সব অনিয়ম-দুর্নীতি  দূরীকরণে সরকার কর্তৃক প্রণীত ‘দিবাযত্ন কেন্দ্র বিধিমালা-২০২২’-এর যথাযথ বাস্তবায়ন এবং প্রতিটি কর্মস্থলে ডে-কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে দেশের অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠীর আত্মনির্ভরশীলতায় সহায়তা করা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।

নুসরাত জাহান ঈশা

সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়