‘আমি দশম শ্রেণির ছাত্র, পাঠ্যপুস্তক থেকে কিছু শিখছি নাকি গিলছি?’

আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি। সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে। কেবল মাসিক বারো টাকা বেতনে পড়ার সুযোগ দিয়েছে সরকার। বইও দিচ্ছে বিনামূল্যে। এই মনে করে যে, আমি ভালো করে শিক্ষা অর্জন করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবো।

স্কুলের স্যার-ম্যাডাম বলেন আমি নাকি বেশ ভালো ছাত্র। ঠিকমতো পড়াশোনা করি। বেশ ভালো নম্বর আসে আমার পরীক্ষায়। বলবেই তো। গত বাংলা পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের মধ্যে ৯৭ পেয়েছিলাম। তাই স্যার মনে করেন ভালোই শিখছি।

আসলে কথাটাকে একটু সংশোধন করা দরকার। শিখছি না গিলছি এটা ভাবার বিষয়। এই তো আগেরবার বাংলা পরীক্ষার আগে মা বলেছিলেন, ক্লাসে সবচেয়ে বেশি নম্বর আমাকেই তুলতে হবে। তাই বই আর বিশাল বড় একটা গাইড বই নিয়ে বসে পড়লাম। যা যা লেখা ছিল সব এক এক করে নিজের ভেতর সাঁটালাম। আর পরীক্ষার খাতায় উল্টো করে ঢেলে দিলাম। কাহিনি খতম। ভালো নম্বর ঠিক চলে আসলো। কী বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা আসুন বিস্তারিত শোনাই পরীক্ষার দিনের ঘটনা।

সকালে জাতীয় কবি নজরুলের ‘মানুষ’ কবিতা নিয়ে বসেছি। পড়লাম যে ধর্ম-কর্ম মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি করতে পারে না। মানুষের চেয়ে বড় আর কিছু নেই। উঁচু নিচু জাত বলতে কিছু হয় না। সকলেই সমান। এদিকে স্কুলে ঢোকার সময় দারোয়ান চাচা আমাকে সালাম দিলে শুনেও জবাব না দিয়ে চলে গেলাম। কারণ মানুষ কবিতা আমি গিলেছি। শিখিনি।

কিশোর কবি সুকান্তের ‘রানার’ কবিতা পড়লাম। লেখা ছিল শ্রমজীবী মানুষদের যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে। তাদের শ্রমের মূল্য দিতে হবে। কেননা তাদের কঠোর শ্রমের বিনিময়ে আমরা আরামদায়ক এই সভ্যতা পেয়েছি। অথচ বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশায় করে স্কুলে আসার পর বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা মামা দশ টাকা ভাড়া বেশি দাবি করায় তাকে ধমক দিয়ে বসলাম। কারণ আমি রানার কবিতা গিলেছি, শিখিনি।

গদ্যাংশের একটা গল্প পড়লাম, ‘মমতাদি’। লেখক বলতে চেয়েছেন গৃহকর্মীদেরও নিজস্ব আত্মমর্যাদা আছে। আমাদেরকে তাদের যথাযথ মর্যাদা প্রদান করতে হবে। কিন্তু পরীক্ষা শেষে বাসায় ফেরার পর যখন দেখলাম আমার ঘর পরিষ্কার করা হয়নি তখন আমার মায়ের বয়সী কাজের খালাকে গালমন্দ করলাম। কারণ আমি মমতাদি গিলেছি, শিখি নাই।

প্রতিনিয়ত এমন হাজারো জিনিস আমি গিলছি আর পরীক্ষার খাতায় উল্টো করে ঢেলে দিয়ে ভালো নম্বরে পাস করছি। রোল নম্বর এক-দুই হচ্ছে। কিন্তু দিন শেষে কিছুই শেখা হচ্ছে না।

‘ক্লাসে ভালো নম্বর পেতে হবে। রোল এক-দুই হতে হবে। ভালো রেজাল্ট করে ভালো চাকরি করতে হবে। বড় বড় বাড়ি আর অনেক দাগি গাড়ি কিনতে হবে’—এসব আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে গিয়ে ভুলেই গেলাম জীব হিসেবে জন্মেছি ঠিকই, আমাকে তো ভালো মানুষ হতে হবে!

জুনায়েদ আহমেদ
আদর্শ সদর, কুমিল্লা