ফেসবুক রিল: ৩ সেকেন্ডেই কি সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে আমাদের সবকিছু

বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্যতম ট্রেন্ডিং বিষয় রিলস। এই সংক্ষিপ্ত ভিডিওতে একবার আঙুল পড়লে আর থামার নাম নেই, অল্প সময়ে ব্যবহারকারীর মনে আনন্দের উদ্রেক ঘটায় বলে এই রিলের ব্যাপক জনপ্রিয়তা।

ফেসবুকের ভিডিও ফিচার রিলসের ভিডিওগুলোর সময়সীমা হয়ে থাকে ৩ থেকে ৬০ সেকেন্ড পর্যন্ত। আপাতদৃষ্টে এতে সময় নষ্ট হয় না মনে হলেও দিন শেষে দেখা যায় ৩ সেকেন্ড করতে করতে দিনের বেশির ভাগ সময় রিলের পেছনেই চলে যায়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মারপ্যাঁচে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বইপড়া, মুভি দেখা বা খবরের কাগজে চোখ বোলানো তো অনেক আগেই বন্ধ হয়েছে, কিন্তু এখন রিলের জন্য দেখা দিচ্ছে নতুন এক মানসিক সমস্যা।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই সংক্ষিপ্ত ভিডিওতে বুঁদ হয়ে থাকা তরুণ-তরুণীরা একটা নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বেশি সময় মনোযোগ ধরে রাখতে পারছে না, এমনকি প্রয়োজনীয় বা শিক্ষণীয় কোনো ভিডিও যদি একটু বেশি সময়ের হয়ে থাকে তাহলে সময় বাঁচাতে তারা সেটিকে দ্বিগুণ×গতি বাড়িয়ে দিয়ে দেখে, তাদের সময়ের এত মূল্য অথচ সেই সময়টিকে কোনো মূল্যবান কাজে ব্যয় করছে না।

দিনের সিংহভাগ সময় ৩ সেকেন্ডের রিল দেখতে দেখতে এখন তাদের পৃথিবীর সবকিছুই ৩ সেকেন্ডে জানতে ইচ্ছা হয়, লম্বা সময়ের ক্লাস লেকচার থেকে শুরু করে দরকারি সব কনটেন্ট অনেকের কাছে বিরক্তিকর হয়ে উঠছে, যার ফলাফল ভবিষ্যতে ভালো কিছু বয়ে আনবে না।

মনোবিজ্ঞানের ভাষায় যে মানসিক প্রক্রিয়া অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে থেকে কোনো একটি বিষয়ের দিকে আমাদের চেতনাকে কেন্দ্রীভূত করে, তাকে মনোযোগ বলে। মনোযোগের বিস্তার পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রটি হলো ট্যাকিস্টোস্কোপ।

বিজ্ঞান বলে, একজন মানুষের গড় মনোযোগ স্প্যান ৮ দশমিক ২৫ সেকেন্ড। তবে এটি ব্যক্তিভেদে ২ সেকেন্ড থেকে ২০ মিনিটের বেশি সময় হতে পারে। মানুষের বয়স, পরিবেশ এবং নিত্যদিনের কার্যকলাপের প্রকারের মতো বিভিন্ন কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মনোযোগের স্প্যানের পরিবর্তন হয়ে থাকে।

একটি পরিসংখ্যানে এসেছে, ২০০০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মানুষের গড় মনোযোগের স্প্যান প্রায় ২৫ শতাংশ কমেছে এবং তা আশঙ্কাজনকভাবে আরও কমছেই, এটি সব সময়ের জন্য উদ্বেগের কারণ না হলেও অল্প মনোযোগ একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছালে তা একটি অন্তর্নিহিত রোগের লক্ষণ প্রকাশ করে, যাকে বলা হয় মনোযোগ ঘাটতি বা হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার (এডিএইচডি)।

এডিএইচডি আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রায়ই মনোযোগ দিতে এবং তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে সমস্যা হয়।

প্রতি ৩ সেকেন্ড পরপর ভিডিও পরিবর্তন হচ্ছে, কোনো ভিডিও হাস্যরসাত্মক যা দেখে দর্শকদের চোখ আনন্দে চকচক করছে, পরের ভিডিওটি আবার বিয়োগাত্মক, যা দেখে চকচকে চোখে জমাট বাঁধা পানি টলমল করছে, এত দ্রুত পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানুষের আবেগ কি আদৌ খাপ খাইয়ে নিতে পারে!

এই ফেসবুক রিল আস্তে আস্তে মানুষকে আবেগশূন্য করে দিচ্ছে, কারও মৃত্যুর খবরে এখন আমাদের কষ্টের স্থায়িত্বকাল মাত্র ৩ সেকেন্ড, কোনো দুর্ঘটনার খবর আর আমাদের শরীরকে অসার করে দেয় না, মনে কষ্ট নিয়ে আঙুলের ইশারায় ফোনস্ক্রিন স্ক্রল করে নিচে নেমে কোনো কৌতুকপূর্ণ রিলে পরমুহূর্তেই আমাদের ঠোঁট প্রসারিত হয়, চোখে আনন্দের ছাপ পরিলক্ষিত হয়, আমরা পরিণত হই আবেগহীন, যন্ত্রমানবে...

আফসানা আক্তার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: [email protected]