জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াটা তাহলে কি আমাদের জন্য অভিশাপ?

সময়মতো পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন
ফাইল ছবি

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯২ সালের ২১ অক্টোবর ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর চাপ কমাতে ও শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে বাংলাদেশের গাজীপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যার্থী তালিকাভুক্তি অনুসারে এটি দেশের সর্ববৃহৎ এবং বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোয় বিভিন্ন কোর্সে অধ্যয়ন করেন ২৮ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী।

শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হওয়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় করোনা মহামারি পরিস্থিতির কারণে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে দীর্ঘ ১৯ মাস বন্ধ রাখা হয়। এর ফলে সৃষ্ট সেশনজটের অনিশ্চয়তায় পড়েছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকেরা। বিশেষ করে, শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকদের মাঝে প্রশ্ন উঠেছে, শিক্ষার্থীরা সময় মতো অনার্স শেষ করতে পারবে তো?

শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তার কার্যক্রমে কতটুকু ভরসা রাখতে পেরেছে, সেটাই এখন মূল আলোচনার বিষয়। যেখানে অধিভুক্ত রয়েছে সারা দেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা সরকারি–বেসরকারি ২ হাজার ২৭৪টি কলেজ।

এদিকে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের মতো সব বর্ষের পরীক্ষা নিচ্ছে। ফলে ব্যাচমেটরা শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে সব পরীক্ষা শেষ করে সময়মতো ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অসহায়ের মতো পরীক্ষার আশায় দিনাতিপাত করছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াটা যেন অভিশাপ।

সেশনজট নামক এই মহা অভিশাপের কারণে দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর জীবন থেকে ঝরে যাচ্ছে মূল্যবান সময়। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীরা হারিয়ে ফেলছেন লেখাপড়া করার ইচ্ছা। তরুণদের দিয়ে পরিচালিত একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘আঁচল ফাউন্ডেশন’ বলছে, করোনায় ১৯ মাসে সারা দেশে ১৫১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশ হচ্ছেন তরুণ-তরুণী।

মূলত যাঁরা পাবলিক বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান না, তাঁরাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন চার বছর মেয়াদি অনার্স কোর্সের জন্য। আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। মা–বাবা তাঁদের জন্য যে মাসিক টাকা পাঠান, তার জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্ট করে টাকা উপার্জন করে পাঠাতে হয়।

এমনকি অনেক সময় না খেয়ে থেকে অথবা মানবেতর জীবন যাপন করেও টাকা পাঠান তাঁরা। তাঁদের একটা স্বপ্ন থাকে ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করে একটা ভালো চাকরি করলে তাঁদের আর কষ্ট থাকবে না। কিন্তু সেই স্বপ্ন অনেকটা দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। করোনার জন্য স্থবির হয়ে থাকা শিক্ষাব্যবস্থায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যেন আরও এক ধাপ পিছিয়ে।

২০১৪ সাল থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে সেশনজটমুক্ত ঘোষণা করা হয়। করোনা পরিস্থিতির পূর্বে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বাভাবিক গতিতেই চলছিল। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছিলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আগে বলা হতো এটা মালটানা রেলগাড়ির মতো। কিন্তু এখন এটি সম্পর্কে বলা হয় দ্রুতগামী আন্তনগর ট্রেন’। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেই পুরোনো সংকট এখন নতুন গতিতে আবার বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থীরা অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছেন প্রায় ১৪ মাসে একাডেমি বছর শেষ করে। অন্যদিকে মাস্টার্স ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থীরা এক বছরের কোর্সের জন্য প্রায় দুই বছর পর পরীক্ষা দিয়েছে। এ ছাড়া বারবার রুটিন পরিবর্তন, হুটহাট রেজাল্ট প্রকাশ করা ও ওয়েবসাইট সমস্যা তো আছেই। কোনো একটা বর্ষের রেজাল্ট প্রকাশ করা হলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট প্রায় অকেজো হয়ে থাকে, যার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রায় দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় কখন ওয়েবসাইট ঠিক হবে।

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে এ সমস্যা মেনে নেওয়ার মতো নয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকেও পিছিয়ে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অভিভুক্ত সাত কলেজ ও ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষা নিয়ে একাডেমি বর্ষ ছোট করে ১৯ মাসের সেশনজট কমিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে মালটানা গাড়ির মতোই। যার ফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন।

আবার অন্যদিকে অলিতে-গলিতে যত রকম কলেজ আছে, সব জায়গায় সম্মান কোর্স চালু করে রাখা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে প্রতিষ্ঠানে সম্মান কোর্স চালু করা হয়েছে। সেখানে না আছে অবকাঠামো, না আছে পর্যাপ্ত শিক্ষক আর না আছে শিক্ষার্থী। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে তাঁরা পাচ্ছেন না চাকরি, আর না পারছেন ভালো কিছু করতে, এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে বেকারত্ব। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী আবার চাকরির বয়স নিয়েও শঙ্কিত। অনার্স যদি দেরিতে শেষ হয় তাহলে চাকরির জন্যও সময় কম পাবেন তাঁরা।

সেশনজট নামক এই মহা অভিশাপের কারণে দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর জীবন থেকে ঝরে যাচ্ছে মূল্যবান সময়। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীরা হারিয়ে ফেলছেন লেখাপড়া করার ইচ্ছা। তরুণদের দিয়ে পরিচালিত একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘আঁচল ফাউন্ডেশন’ বলছে, করোনায় ১৯ মাসে সারা দেশে ১৫১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশ হচ্ছেন তরুণ-তরুণী। সেশনজটের কারণে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে শূন্য দশমিক ৮২ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের করুণার ওপর নির্ভর করে আছে এ দেশের অসংখ্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আস্থা।

পরিশেষে বলতে চাই, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থা নিতে হবে। পূর্বের ন্যায় প্রতিটি কলেজে শিক্ষার পরিবেশ সুনিশ্চিত করতে হবে। একাডেমি বর্ষ ছোট করে সিলেবাস কমিয়ে হলেও শিক্ষার্থীদের হারিয়ে যাওয়া সময়গুলো পুষিয়ে নিতে হবে এবং দ্রুত পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ করতে হবে। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। পূর্বের ন্যায় ক্রাশ প্রোগ্রাম ব্যবস্থা করে দ্রুত পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা চাই, সেশনজটমুক্ত হোক সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং জ্ঞানের প্রবাহ হোক বাধাহীন।

আহমেদ জুনাইদ
শিক্ষার্থী, আনন্দ মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ