মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্স বাড়াতে আমরা কেন ভাষা শিক্ষায় গুরুত্ব দিই না

বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ হওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার আমাদের প্রথম পছন্দের তালিকায় থাকে। আমাদের দেশে বিদেশযাত্রা মূলত শুরু হয় সত্তরের দশকে। তখন কাজের জন্য বিদেশ যাওয়া বলতে বোঝা যেত মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও কাতার এসব দেশে যাওয়া।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১ কোটি ৪৫ লাখ ৮ হাজার বাংলাদেশি সংস্থাটির ছাড়পত্র নিয়ে বিদেশে গিয়েছেন। এর মধ্যে ৫১ লাখ ৮২ হাজারই গিয়েছেন সৌদি আরবে।

সৌদি আরবকেই বিবেচনা করে আলোচনার বিশ্লেষণ করি। সৌদি আরবে গিয়ে আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষের কাজ শুরু হয় বাগানে কাজ, নয়তো পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে রাস্তায় কিংবা গৃহকর্মীর কাজ করে, যা একদিকে মরুভূমির দগ্ধ পরিবেশে খুবই কষ্টসাধ্য ও বেতনেও কম। নারী শ্রমজীবীরা আরও বেশি কষ্টের সম্মুখীন হন।

গত বছর বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড বাংলার এক প্রতিবেদনে অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘মূলত মধ্যপ্রাচ্যে নারী কর্মীরা গৃহস্থালি কাজে ভাষা না জানার কারণে শারীরিক নির্যাতনসহ বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হন। অন্যদিকে বেশির ভাগ পুরুষ কর্মীরা ম্যানুফ্যাকচারিং, নির্মাণ খাত, সার্ভিস সেক্টরসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করেন। যেখানে সরাসরি ভাষার কারণে সমস্যার সম্মুখীন না হলেও তাঁরা রেমিট্যান্সে পিছিয়ে থাকেন। তাঁরা যদি স্থানীয় ভাষা জানতেন, তাহলে স্বল্প দক্ষ কাজে না গিয়ে আরেকটু ভালো কাজ করে বেশি আয় করতে পারতেন, যেটা আমরা শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও ভারত এসব দেশের অভিবাসী কর্মীদের ক্ষেত্রে দেখতে পাই।’

শাকিরুল ইসলামের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ডেইলি স্টার–এ পড়া একটা কলামের কথা মনে পড়ল। ওই কলামে লেখক ফিলিপাইন ও বাংলাদেশের শ্রমিকদের বেতনের বৈষম্য নিয়ে বিশ্লেষণ করেছিলেন। যেখানে শ্রমবাজারের বাংলাদেশের শ্রমিকের সংখ্যা বেশি কিন্তু রেমিট্যান্সের পরিমাণ ফিলিপাইনের প্রবাসীদের বেশি।

এই আকাশ-পাতাল বৈষম্যের একমাত্র কারণ ভাষার দক্ষতা। তবে তিনি ওখানে অবশ্য ইংরেজি ভাষার দক্ষতাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। আর এই ভাষার দক্ষতা পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিপাইনের প্রবাসীরা হোটেল–রেস্তোরাঁ কিংবা শপিং মলে বিক্রেতা হিসেবে কাজ করে কিংবা বেবি সিটার হিসেবে কাজ করেন, যা একদিকে যেমন কম কষ্টসাধ্য, অন্যদিকে বেতনের পরিমাণও বেশি; যার পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিপাইন প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের পরিমাণও বেশি হয়।

এদিকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) ২০১৯ সালের তথ্যমতে, প্রবাসী একজন বাংলাদেশি কর্মী মাসে গড়ে ২০৩ ডলার ৩৩ সেন্ট রেমিট্যান্স পাঠান। সে তুলনায় ফিলিপিনো একজন কর্মী তাঁর দেশে পাঠান ৫৪৬ ডলার ১০ সেন্ট।

আরেকটি দেশের কথা না বললেই নয়। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত। বিএমইটির তথ্য বলছে, ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২৪ লাখ ৮৫ হাজার বাংলাদেশি সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী হয়েছেন। সরকারি সংস্থাটির ছাড়পত্র নিয়ে বিদেশগামী বাংলাদেশিদের ১৭ দশমিক ১৩ শতাংশ গিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশটিতে। এর মধ্যে অনেকে দেশে ফিরে এসেছেন। তবে এখনো আমিরাতে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের সংখ্যা ১০ লাখের বেশি।

এত চড়াই-উতরাইয়ের পরও যেহেতু বাংলাদেশিরা মধ্যপ্রাচ্যকেই পছন্দের প্রথম স্থান ধরে রেখেছেন। তাই আমাদের উচিত শ্রমবাজারের সব প্রকার পরিকল্পনা ও দৃষ্টিভঙ্গি মধ্যপ্রাচ্যের ওপর ভর করেই যেন হয়।

মধ্যপ্রাচ্য লোহিত সাগর ও পারস্য উপসাগরকেন্দ্রিক। মধ্যপ্রাচ্যের দেশের সংখ্যা ১৮। তবে এই ১৮ দেশসহ মোট ২৬ দেশে সরকারি ভাষা হিসেবে আরবি ব্যবহৃত হয়। ব্যবহারকারীর দিক থেকে আরবি ভাষার অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়।

গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল শীর্ষক জোটভুক্ত ছয়টি দেশে প্রবাসী হার ও স্থানীয় জনসংখ্যা বিন্যাস; সংযুক্ত আরব আমিরাত (৮৮.৫ শতাংশ প্রবাসী), কাতার (৮৫.৭ শতাংশ), কুয়েত (প্রায় ৬৯.২ শতাংশ) বাহরাইন (৫২ শতাংশ), ওমান (৪৪ শতাংশ) ও সৌদি আরব (৩২.৭ শতাংশ)। তার মানে বুঝতেই পারছি, মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজারের চাহিদা কেমন!

সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো, আরবি ভাষাভাষী লোকেরা ইংরেজি বা অন্য ভাষায় খুবই কাঁচা। আর তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজারের চাহিদা তো আমরা ভালো করেই জানি। এই দেশগুলো মুসলিম প্রধান দেশ হওয়ায় শ্রমিক হিসেবে মুসলিমরা অগ্রাধিকার পাবেন, এটা নিরেট সত্য। কেননা, আমরা মানুষ। মানুষ হিসেবে এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুর্বল মনোভাব থাকবেই। এটা অস্বীকার করার মতো কিছু নেই। সেদিক থেকে বাংলাদেশের শ্রমিকেরা অগ্রাধিকার পাবেন।

আমরা জানি, দেশে দুই ধরনের মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা আছে—কওমি ও আলিয়া। দুই ধরনের মাদ্রাসার অধিকাংশ শিক্ষার্থী আরবি লিখতে, পড়তে ও বলতে জানে। বিশাল এই শিক্ষার্থীদের যদি মধ্যপ্রাচ্যের দিকে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়, তাহলে শ্রমবাজারে তাদের এক বিশাল আধিপত্য সৃষ্টি হবে। আর তারা অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকবে। তার কারণ হলো, তারা আরবি লিখতে ও পড়তে জানে, অন্যদিকে অন্য দেশের শ্রমিকেরা শুধু আরবি বলতে পারেন।

তা ছাড়া মাদ্রাসাগুলোয় একটা কোর্স সংযুক্ত করা যেতে পারে। যে কোর্সে তাদেরকে কারিগরি শিক্ষা দিয়ে দক্ষ রেমিট্যান্স–যোদ্ধা হিসেবে রূপান্তরিত করবে। সরকারের ব্যাপক সহযোগিতা এই ক্ষেত্রে প্রয়োজন। আবার কওমি আলেমদের এ ক্ষেত্রে সচেতন ও সজাগ দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে হবে।

যেহেতু মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ইসলামি অনুশাসনের বিষয়গুলো বোঝে ও মানার চেষ্টা করে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের কর্তাদের সঙ্গে বেশ সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পারবে এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের শ্রমিকদের প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের কর্তাদের আরও আগ্রহ সৃষ্টি হবে। ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের ভাবমূর্তি আরও উন্নত হবে।

অন্যদিকে আমরা স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য প্রণীত ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইয়ে আরবি ভাষা বলা ও লেখা শিখনবিষয়ক অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারি কিংবা শিক্ষার্থীদের ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা কোর্সে মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে ব্যবহারিক পরীক্ষায় ৩০ নম্বর রাখতে পারি শুধু আরবি ভাষার দক্ষতা আয়ত্তের ক্ষেত্রে। (যেমন তাত্ত্বিক ৭০ ও ব্যবহারিক ৩০) এভাবে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও আরবি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করবে, যা পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে তাদের একজন দক্ষ রেমিট্যান্স–যোদ্ধায় পরিণত হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।

আমি যখন আনন্দ মোহন কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি, তখন একবার দেখেছিলাম, কোরীয় ভাষা শিক্ষার ক্লাব। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি। পাঁচ বছর হয়েছে কলেজজীবন শেষ করার। এই পাঁচ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে বিভিন্ন জেলার নানা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিচয়। কখনো শোনলাম না বা দেখলাম না যে অন্য অনেক ভাষা চর্চার মতো আরবি ভাষা শিক্ষা ভাষা শিক্ষার কোর্স চলছে। আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাই যখন এসব কোর্সের তথ্য পাই না, সেখানে গ্রামীণ জনপদের কোনো এক কোণে বসবাসরত ইন্টারনেটবিহীন ছেলেটা কীভাবে স্বপ্ন দেখবে ভাষা শিক্ষার কোর্স করে নিজেকে দক্ষ রেমিট্যান্স–যোদ্ধায় পরিণত করে মধ্যপ্রাচ্যে যাবে?

তাই মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী কর্মী পাঠাতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন কোর্স চালু করা উচিত। সেখানে থাকবে আরবি ভাষা শিক্ষার কোর্সও। সেসব কোর্সের বিষয়ে ব্যাপকভাবে প্রচারণাও চালাতে হবে। কোর্সগুলোর বিষয়ে মানুষকে জানাতে হবে। আরবি ভাষা শিক্ষাসহ নানা বিষয়ে কোর্স করা থাকলে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার সম্পর্কে একটি আগাম ধারণা ও প্রস্তুতি থাকবে, যা একজন প্রবাসীকে দক্ষ রেমিট্যান্স–যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করবে।

শেখ সায়মন পারভেজ
শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়