শিশুকে কেন আর চাঁদ মামা–কাজলা দিদির কবিতা শোনানো হয় না?

বর্তমান সময়ে কম্পিউটার মনিটর কিংবা মোবাইলের স্ক্রিনের প্রতি শিশুর আসক্তি আমাদের একটি ভয়াবহ সংকটের আভাস দেয়। এমন পরিস্থিতি নতুন প্রজন্মের নিরাপদ পৃথিবীর অন্তরায়। বৈশ্বিক রাজনৈতিক সংকট, অর্থনৈতিক সংকট, জলবায়ু সংকটের মতো আগামী প্রজন্মের সংকটকেও ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। একজন শিশুর আধুনিকায়ন এবং মেধা বিকাশের একমাত্র মাধ্যম মোবাইল ফোন—এমন ভাবনা শিশুর সুরক্ষিত পৃথিবীর জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

আধুনিক জীবনযাপনে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলা জীবনের একটি অংশমাত্র; সম্পূর্ণ জীবন কিন্তু নয়। বর্তমান পৃথিবীতে আমাদের চিন্তা চেতনায় বিপত্তি বেঁধেছে এখানেই। নতুন প্রজন্মের বড় একটি অংশ প্রযুক্তিকে জীবনের একমাত্র অংশ ভেবে বসে আছে। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক, খুব ছোট বয়সে শিশুর কান্না থামানোর জন্য চাঁদমামা অথবা কাজলা দিদির কবিতা এখন আর শোনানো হয় না বলে সেসব সংস্কৃতি এখন বিলুপ্ত প্রায়। তার পরিবর্তে শিশুর হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেওয়ার মতো ভয়াবহ কাজটি অনেক বাবা মা-ই করে থাকেন।

ভুলের শুরুটা হয় এখান থেকেই। যার ফলে শিশু বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে তৈরি হয় প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীলতা। যা প্রতিটি মুহূর্তে শিশুর জীবনে বড় আকারের অদৃশ্য ক্ষতের সৃষ্টি করে। অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা শুধু যে সময়ের ক্ষতি করে তা নয়, শারীরিক এমনকি মানসিক সংকটও দানা বাঁধে শিশুর মস্তিষ্কে। এই সংকট হয় দীর্ঘস্থায়ী। ঠিক ক্যানসারের কোষ আক্রান্ত হওয়ার মতো। ধীরে ধীরে ক্ষতি করতে করতে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যায় যে, শেষ পর্যায়ে পদক্ষেপ নেবার মতো আর কিছুই করার থাকে না ।

দেশে অনবরত খেলার মাঠ দখল হচ্ছে, খোলা জায়গা ভরাট করে দালান-কোঠা, কল-কারখানা তৈরি হওয়ায় শিশুরা চার দেয়ালে বন্দী হয়ে থাকতেও বাধ্য হচ্ছে, যা আগামী প্রজন্মকে এক প্রকার অন্ধ বানিয়ে ফেলছে। আমাদের কাঠামোগত এমন ধরনের পরিবর্তন অবশ্যই ভালো নয়। শিশুর সুরক্ষিত পৃথিবী নিশ্চিত করতে এই নির্দিষ্ট সংকটগুলোর সমাধান করা সরকারের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ব্যাপারগুলোর মতোই গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত।

নব্বইয়ের দশক অবধিও আমাদের দেশে সবুজ মাঠে তারুণ্যের ছোটাছুটি, দল বেঁধে নদীতে ঝাঁপাঝাঁপি করার দৃশ্য চোখে পড়েছে ; এখন আর তেমন নেই। প্রযুক্তি কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা বর্তমান প্রজন্মের শিশুদের চিন্তাশক্তিকে প্রতিনিয়ত একপেশে এবং আবদ্ধ করে তুলছে। কম্পিউটার মনিটর বা মোবাইল ফোনের বাইরেও সুন্দর একটি সামাজিকীকরণ ব্যবস্থার পৃথিবীতে আমাদের বসবাস; শিশুদের কাছে এই বার্তাটি পৌঁছানো আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

একজন শিশুকে অন্য দশজন শিশুর সাথে মাঠে খেলতে দেওয়ার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। দায়িত্ববোধ, সহমর্মিতা, পরমতসহিষ্ণুতা, সত্যবাদিতাসহ সমাজের সকল মানুষের সাথে মিলেমিশে বসবাস করার মানসিকতার ভিত্তি মূলত তৈরি হয় এই সময়ে। শিশুকে অন্যের বিপদে এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষা দিন। জীবনে বেঁচে থাকার জন্য সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের বিকল্প নেই। খুব ছোট বয়স থেকে শিশুর মানসিকতার উন্নয়ন ব্যাপকভাবে আজীবনের শিক্ষা হিসেবে কাজে দেয়।

চাষাবাদের সময়ে জমিতে নরম মাটিকে যেমন ফসল ফলনের জন্য উপযোগী করে তোলা হয়— আমাদের শিশুদেরকে ছোটবেলা থেকেই সমাজ সংস্কৃতির মতো করে গড়ে তুলতে হবে। শিশুর পথ চলায় কোনো বাধা-বিপত্তকে সততার সাথে মোকাবিলা করার উপায় আবিষ্কারের শিক্ষা শিশুর বিকাশের জন্য সমান গুরুত্ব বহন করে।

স্বাধীনতার অর্থ খেয়ালখুশি অনুযায়ী যা ইচ্ছে তাই করা নয়— এই শিক্ষা শিশুকে জীবনমুখী হতে এবং নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করবে। পারিবারিক শিক্ষা কিংবা প্রাথমিক শিক্ষা একটি শিশুর জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হলেও আমাদের সেই সীমারেখাকে শতভাগ অবধি নিয়ে যেতে হবে। একটি শক্তিশালী ভিত্তির উপর বেড়ে ওঠা শিশু খুব কম সময়েই বিপথে যায় ।

নবীনদের আচরণগত বিকাশ কেমন হবে তা নির্ভর করে প্রবীণদের উপর। শিশুরা সাধারণত অনুকরণ করার মাধ্যমে শিখতে পছন্দ করে। প্রবীণদের আচরণগত বৈশিষ্ট্য নবীনদের সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে তাই আচরণগত ক্ষেত্রকে প্রথমদিকের বিবেচনায় রাখা উচিত। অপরের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা, সততা, আচরণগত সৌন্দর্য বিকশিত হওয়ার জন্য শিশুকে চার দেয়ালে বন্দী করে রাখা চরম অকার্যকর পদ্ধতি। একটি শিশু মাঠে বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করে যে শিক্ষালাভ করবে; বাস্তব জগতে প্রযুক্তিগত শিক্ষা তার একাংশও দিতে পারবে না। আধুনিক পৃথিবীতে তাল মিলিয়ে চলতে যদিও প্রযুক্তির বিকল্প নেই, তবে তার উপর নির্ভরশীলতা এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।

শিশুর মানসিকতা বিকাশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো পরিবার। পারিবারিক সংকট অথবা দূরত্ব শিশুর মনুষ্যত্বকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বাবা-মায়ের দায়িত্ব সন্তানকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে স্নেহ মমতার আভিজাত্য অনুভব করানোর পাশাপাশি তাকে সময় দেওয়া। সুস্থ ও সুন্দর পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখতে বাস্তবমুখী শিক্ষার বিকল্প নেই। এইমাত্র পৃথিবীর কোনো প্রান্তে যে শিশু সদ্য জন্মগ্রহণ করল—উপহার হিসেবে একটি সুন্দর সমাজ পাওয়ার অধিকার তার আছে। তবেই শিশু বড় হয়ে সেই সৌন্দর্যের পরিচর্যা করতে জানবে। সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে শিশুর মেধা ও মনন, চিন্তাশক্তি এবং মানসিকতার উন্নয়নে সুস্থ ও সুন্দরের চর্চা করার জন্য প্রতিটি সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর একটি অবাধ বিচরণক্ষেত্রের প্রয়োজন; যা পরিচর্যা করার দায়িত্ব আমার, আপনার এবং আমাদেরই ।

মো. খশরু আহসান
সাবেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক,
ঢাকা কলেজ ডিবেটিং সোসাইটি