বিজয় দিবস কেবল স্মৃতি নয়; বরং দায়িত্বের উত্তরাধিকার

মহান বিজয় দিবসে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান সর্বস্তরের মানুষ।ফাইল ছবি

ডিসেম্বর এলেই বিজয়ের স্মৃতি ফিরে আসে পতাকা, গান আর আনুষ্ঠানিকতার ভেতর দিয়ে; কিন্তু ৫৪ বছর পর বিজয় দিবস কি কেবল একটি তারিখ, নাকি এখনো এটি জীবিত কোনো চেতনা? দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীদের ভাবনায় বিজয় দিবস আজ আর শুধু ১৯৭১ সালের স্মৃতি নয়, এটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান, বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন এবং স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ খোঁজার এক চলমান লড়াই।

শিক্ষার্থীদের ভাবনা

১. বিজয় দিবস আমাদের কাছে পবিত্র আবেগ এবং শতসহস্র ঘটনায় মোড়ানো একটি ঐতিহাসিক দিন। দিনটি বিভিন্ন আঙ্গিকে উদ্‌যাপন করার সময় আমরা অনেকেই ভুলে যাই দিনটি তাৎপর্য। বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়ায়, যেন এক দিনের চেতনা। গ্রামের কুঁড়েঘর থেকে শহরের গগনচুম্বী অট্টালিকা— সবখানেই যেন শোভা পায় জাতীয় পতাকা । যে কেবল বিজয় দিবসের স্নিগ্ধতা অনুভব করে, যার কাছে বিজয় দিবস মানে একগুচ্ছ ফুলের শ্রদ্ধাঞ্জলি, সে বিজয় দিবসের মহত্ত্ব বোঝে না। এমন শতসহস্র ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি বিজয় দিবস । সুতরাং শুধু বিজয় দিবস জানলেই হবে না, যেই পথ ধরে বিজয় এসেছে, সেই পথের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে গড়ে ওঠা সংগ্রাম সম্পর্কেও আমাদের জানতে হবে। বিজয় আসার আগে সংগঠিত সব বিপ্লবের বিপ্লবীদের প্রতি আজ বিজয় দিবসের বিনম্র শ্রদ্ধা।’

—শিক্ষার্থী: হামিম সিয়াম, ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, সদরপুর সরকারি কলেজ।

২. ‘মহান বিজয় দিবস নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য একটি গৌরবের দিন। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয় দিবস। এটা আমাদের আত্মপরিচয়ের দিন। বিজয় দিবসে আমার প্রত্যাশা—সোনার বাংলা হবে এমন এক দেশ যেখানে দারিদ্র্য ও শোষণের কোনো স্থান থাকবে না। বিজয় দিবসে আমি শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন চাই। আমি চাই, বেকারত্বের সমাধান এবং কর্মক্ষেত্রে কোনো প্রকার বৈষম্য থাকবে না। আমরা সুশিক্ষিত, স্বাবলম্বী ও দেশপ্রেমী প্রজন্ম চাই। যারা হবে সৎ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী হাতিয়ার।

আমাদের এমন একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে সবার জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায়বিচার। বিজয় দিবস হোক নতুন শপথ নেওয়ার দিন, মানবিক ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার শপথ। যার আলোয় আলোকিত হবে আমাদের দেশ।’

—শিক্ষার্থী: শিপন খান, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

৩. ‘বিজয় মানে হচ্ছে জয়, সাফল্য, কোনো যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে আত্ম–অধিকার অর্জন করা।’

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাস বাঙালি জাতি রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর অর্জন করে তাদের বিজয়। শিক্ষার্থীদের কাছে বিজয় দিবস শুধু একটি ছুটির দিন নয়, এটি দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও বিজয়ের গৌরবের প্রতীক। শিক্ষার্থীদের ভাবনা, নতুন প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়া, সমৃদ্ধ দেশ গড়ায় শপথ নেওয়া এবং ইতিহাসকে শুধু বইয়ের পাতায় না রেখে, সারা বছর এর অনুশীলন করা প্রয়োজন। বিজয় দিবসকে কিছু কর্মসূচি বা উৎসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে এর যথার্থ তাৎপর্য ও উপলব্ধি সবার মধ্যে সম্প্রসারণ করা জরুরি। কেননা, এর উপযুক্ত মর্ম উপলব্ধি করতে না পারলে বিজয়ের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে।’

—শিক্ষার্থী: পায়েল আক্তার, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ

৪. ‘১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পূর্ব পাকিস্তান দীর্ঘ ২৩ বছর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ ও বৈষম্যের শিকার হয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এই অবস্থা একসময় প্রতিবাদে রূপ নেয়। ১৯৭১ সালে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি বিজয় অর্জন করে এবং ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভ করে।

এই মহান বিজয়ের মধ্য দিয়েই পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় একটি নতুন রাষ্ট্র—বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ফিরে পায় তার হারানো সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার এবং বাঁচার মৌলিক অধিকার। বিশ্ব মানচিত্রে গর্বের সঙ্গে ফুটে ওঠে একটুকরা “লাল-সবুজ” বাংলাদেশ।’

—সাজেদুল ইসলাম, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

৫. ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করে আমাদের বাংলাদেশ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর আমরা পাই স্বাধীন একটি ভূখণ্ড। স্বাধীন দেশে আমাদের লড়তে হচ্ছে ভারতীয় আদিপত্যবাদের বিরুদ্ধেও। ভারত এখনো সীমান্তে আমাদের গুলি করে মারে।

২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা বুঝিয়ে দিয়েছি, আমরা কোনো আধিপত্যবাদ মানি না। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর আমরা নতুন একটি ফ্যাসিবাদমুক্ত দেশ পেয়েছি। এটি আজন্ম ধরে রাখব। দেশের মর্যাদা রক্ষার্থে আমরা স্লোগান তুলেছি,‘জন্মভূমি অথবা মৃত্যু’। দেশের আপামর জনতার মুক্তির জন্য আমরা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত। এটি হোক আমাদের বিজয় দিবসের শপথ

—শিক্ষার্থী: আবদুল কাদের জীবন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

৬. ‘১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। এক রক্তক্ষয়ী তীব্র সংগ্রাম, কল্পনাতীত আত্মত্যাগ ও অসংখ্য নারীর সম্ভ্রম বিসর্জনের বিনিময়ে আমরা যে বিজয় অর্জন করেছি, সে বিজয় আমাদের অস্তিত্বের শিকড়। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে সেটি আরও গভীরভাবে অনুভব করতে পারি। একই সঙ্গে এক অদ্ভুত বেদনাও অনুভব করি। কারণ, ১৯৭১ সালে অর্জিত গৌরবোজ্জ্বল বিজয়ের আজ ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও দেশের তরে বিলিয়ে দেওয়া লাখো শহীদের প্রাণ ও অজস্র নারী-পুরুষের জীবন উৎসর্গের যথাযথ মূল্যায়ন আমরা করতে পারিনি। তাঁদের স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের মধ্য দিয়েই আমাদের সেই কলঙ্ক দূর করতে হবে। এটা আমাদের জাতিগত দায়বদ্ধতা।’

—শিক্ষার্থী: হাফিজুর রহমান আরাফাত, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

৭. ‘শিক্ষার্থীদের কাছে বিজয় দিবস শুধু একটি সরকারি ছুটির দিন নয়; এটি ত্যাগ, সংগ্রাম, গৌরব ও জাতীয় আত্মপরিচয়ের এক শক্তিশালী প্রতীক। এ দিনটি তাদের মনে করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, শহীদদের আত্মত্যাগ এবং স্বাধীনতার প্রকৃত মূল্য। বিজয় দিবস শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধকে আরও দৃঢ় করে এবং একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি গর্বের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে।

একই সঙ্গে তারা মনে করে, বিজয়ের চেতনা ধারণ করার অর্থ শুধু উদ্‌যাপন নয়; বরং শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়া। এ দিনটি তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন প্রত্যাশা ও প্রেরণা জোগায় এবং সামাজিক সম্প্রীতি, দায়িত্ববোধ ও দেশের সার্বিক উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখার আহ্বান জানায়। শিক্ষার্থীদের ভাবনায় তাই বিজয় দিবস হলো অতীতের ত্যাগ, বর্তমানের চেতনা ও ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতির এক অনন্য মিলন।’

—শিক্ষার্থী: আরফিন জাহান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ

৮. ১৬ ডিসেম্বর বাংলার ইতিহাসে আলোকিত এক প্রভাত— এটি এমন একটি দিন, যা বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার অন্ধকার থেকে মুক্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ৯ মাসের রক্তাক্ত সংগ্রাম, অগণিত আত্মত্যাগ ও দুঃসহ অপেক্ষার পর এই দিনে অর্জিত হয় স্বাধীনতার চূড়ান্ত বিজয়। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ ছিল নতুন দেশ জন্ম নেওয়ার ঘোষণা। যা রক্ত, কষ্ট ও সাহসের ফল।

বিজয় দিবস শুধু অতীতের স্মরণোৎসব নয়; এটি ন্যায়, সমতা, মানবিকতা ও স্বাধীনতার চেতনাকে টিকিয়ে রাখার আহ্বান। এটি আমাদের স্মরণ করায় যে, স্বাধীনতা অর্জন যেমন সংগ্রাম ও ত্যাগের ফল, তেমনি সেটিকে রক্ষা ও সমৃদ্ধ করার দায়িত্বও আমাদের। ১৬ ডিসেম্বর তাই কেবল একটি তারিখ নয়, এটি বাঙালির আত্মগৌরব, মুক্তির আলো এবং ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক। এই বিজয় সবার, এই দেশ সবার এবং এই দায়িত্ব আমাদের।

—শিক্ষার্থী: হাসিব সরদার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষার্থীদের বিজয়ের ভাবনা সংগ্রহ: আমির ফয়সাল, শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়