এক টুকরা উষ্ণতার খোঁজে

রাসেল ও আমেনা

ঢাকা শহরে ইতিমধ্যে মৃদু শীতের বাতাস গায়ে লাগা শুরু করেছে। ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে বেলা ফুরাবার পরপরই কিছুটা ঠান্ডা অনুভব হয় এখন। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনেই দিবা–রাত্রি যাপন করেন, এমন মানুষের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। ৯ বছর বয়সী রাসেল তার ছোট বোন আমেনাকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে কমলাপুর স্টেশনে থাকা সেই মানুষদের মধ্যে অন্যতম। খুব সকালে ট্রেনের বিকট শব্দে ঘুম ভাঙে ওদের। কাউকে জাগিয়ে দিতে হয় না। কখনো কখনো ভোর হওয়ার আগে আসা ট্রেনগুলোর শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে আর ঘুম পায় না।

পরিবারের সঙ্গে থাকা শিশুদের মতো ওদের সকাল ব্রাশ করে টেবিলে সাজানো নাশতা দিয়ে শুরু হয় না। মা রোজ সকালে উঠে কাজ কিংবা খাবারের সন্ধানে ওদের রেখে চলে যান। স্টেশনে থাকে বলে বাসা বাড়ির কাজ কেউ দেয় না। শেষমেশ কিছু বাসি খাবার নিয়ে ফিরতে পারেন ওই মা। কিন্তু সেই বাসি খাবার আসতে আসতে কখনো রাতও হয়ে যায়। খাবার নিয়ে খুব একটা চিন্তা নেই রাসেল আর আমেনার। এর ওর কাছ থেকে চেয়ে কিংবা কোনো যাত্রীর ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট নিয়ে দৌড়ে ওদের খাবারের একটা না একটা ব্যবস্থা হয়েই যায়।

স্তব্ধ দুপুরে মাঝেমধে৵ ঘুম পেলে স্টেশনের ফাঁকা কোনো এক কোনায় ঘুমিয়ে পড়ে। স্টেশনে থাকা ওদের বয়সী অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দিনের বেলায় বেশ হেসেখেলেই সময় কাটে দুজনের। রাতের শেষ ট্রেন ছেড়ে গেলে প্ল্যাটফর্ম প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। তখন ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ওদের ঘুমানোর নির্ধারিত জায়গায় ওরা চলে আসে। মায়ের তাদের খুঁজে বেড়ানোর বালাই নেই। গরমের দিনগুলোতে রাতের বেলায় ঘুমাতে খুব একটা সমস্যা হয় না। যত বিপাক বাধে এই শীতের সময়ে। শীতে দিনের বেলায় চলার মতো একটা সোয়েটার আছে আমিনার; কিন্তু রাসেলের যে ওই ছেঁড়া হাফপ্যান্ট আর হাফ গেঞ্জিটাই সম্বল। নতুন কাপড় কেনার সামর্থ্য নেই। আর স্টেশনের আশপাশে দু–একটা পুরোনো কাপড় পেলেও সেটি রাসেলের গায়ের মাপের চেয়ে অনেক ছোট হয়।
শীতের সকালগুলো ভালো কাটলেও রাতগুলো মোটেও ভালো কাটে না ওদের। প্ল্যাটফর্মের ঢালাই করা বেঞ্চগুলো যেন বরফের একেকটা টুকরা হয়ে থাকে। সেটির ওপরে গা এলিয়ে দিলে রাসেলের হাফ গেঞ্জিটা ভেদ করে শরীরে বরফের টুকরা প্রবেশ করে। আমেনার সোয়েটার গায়ে থাকলেও যেন শীত যায় না। ওদের মায়ের কেমন অনুভূতি হয়, এটা ওরা শুনবে শুনবে করে আর শোনা হয়ে ওঠে না।

সারা বছর ঠান্ডা–অসুখ লেগে থাকলেও এগুলোর প্রতি ভ্রুক্ষেপের বিলাসিতা বা ভাবার সময় ওদের নেই। গত বছর শীতে ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে হুট করে মাঝরাতে অনেকগুলো ফ্ল্যাশলাইট আর ক্যামেরাসহ কয়েকজন লোক এসে নাকি বেশ কয়েকবার সোয়েটার আর কম্বল দিয়ে গেছেন। তাঁরা এলে শুধু ১ আর ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মেই সেসব দিয়ে ছবি তুলে যান। ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্ম অবধি যাওয়ার কষ্ট তাঁরা করেন না। একদিন রাসেল সাহস করে ওই সময় ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে গিয়েছিল। ওখানকার কয়েকজন ওকে চিনতে পেরে মারধর করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তারপর থেকে রাসেলের একটাই ইচ্ছা—একদিন শুধু ওদের প্ল্যাটফর্মে আসুক কেউ কম্বল দিতে, ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মের কাউকে তখন আশপাশে দেখলে তাদের রেহাই দেবে না।

এবার শীতেও  রাসেলের অপেক্ষা সেই স্বপ্নের রাতের। যে রাতে হুট করে ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ভদ্রলোকেরা সোজা ঢুকে যাবেন। সঙ্গে ক্যামেরা আর আলোর ঝলকানি। রাসেল আমেনা আর মাকে নিয়ে লাইনে সবার আগে দাঁড়িয়ে কম্বল আর সোয়েটার নেবে। তারপর সতর্ক থাকবে ২ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে কেউ আসেন কি–না। ভদ্রলোকেরা চলে গেলে জমিদারের মতো ওরা তিনজন তিনটা কম্বলের নিচে ঘুমিয়ে যাবে। স্বপ্নের কম্বলের গরমেই হয়তো শীতের এবারের রাতগুলোও কেটে যাবে ওদের। তবুও কেউ হয়তো কষ্ট করে ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্ম অবধি রাসেলদের কাছে যাবেন না ওদের স্বপ্নগুলো পূরণ করতে।

মাহতাব আজমাঈন রিয়াদ
শিক্ষার্থী, নটর ডেম কলেজ, ঢাকা