তাহলে কি বাংলা ভাষার পিঠ ঠেকে গিয়েছে দেয়ালে

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, যে ভাষার জন্য আন্দোলন করে মাতৃভাষা ফিরে পেয়েছি। আমরা জানি, পরিবর্তনই ভাষার ধর্ম। ভাষার পরিবর্তনে অনেক শব্দ আসে, প্রয়োগ আসে, বাগধারা আসে। সেসব গ্রহণ এবং কিছু কিছু পুরোনো শব্দ বর্জন করা হয়ে থাকে।

কিন্তু আজ বাংলা ভাষার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষাটাকে বিকৃতি করে ফেলেছি আমরা। আমাদের দেশে তরুণ প্রজন্মের আধুনিকতার ছোঁয়া লেগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও রাস্তাঘাটে কথোপকথনের সময় বাংলা ভাষার পরিবর্তে ‘হাই ব্রো’ বলে নিজেকে ‘স্মার্ট’ হিসেবে প্রমাণ করছি।

শুধু তা-ই নয়, আমরা এটা দেখে শিখছি এবং এর সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছি। আমরা একে অপরের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রায়ই ইংরেজি শব্দ টেনে নিয়ে আসি অথচ সাবলীলভাবে বাংলা ভাষায় প্রকাশ করতে সেকেলে বোধ করি।

এখন বুঝতে হবে, আমাদের এই ‘স্মার্টনেস’ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের সময় পোস্ট করা সেই ব্যক্তি চ্যাটবক্সে ‘বাংলিশ’ কিংবা ভাঙা ভাঙা ইংরেজি ভাষায় কথা বলছে। প্রথমে আমরা ইংরেজি ভাষায় কথা বলছি, যেটা এখনো ঠিক করে শেখা হয়নি, তবু বাংলা ভাষার মধ্যে ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলছি। দ্বিতীয়ত, বাংলা ভাষার মর্যাদা লঙ্ঘন করে ‘বাংলিশে’ লিখছি। তৃতীয়ত, শর্টকাট ব্যবহার করে আলাপচারিতা করছি। তাহলে আমাদের ভাষার সংস্করণ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে?

শুদ্ধ ভাষায় অথবা নিজের আঞ্চলিক ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করার যে মাধুর্য আছে, এর ভেতরে কিছু বিদেশি শব্দ বলে তা বোঝানো যাবে না। আপনি কখনো বিতর্ক অনুষ্ঠান শুনলে বুঝতে পারবেন বাংলা ভাষা কতটা শ্রুতিমধুর। কিন্তু তারপরও কেন আমরা বাংলা ভাষাকে এভাবে হারিয়ে যেতে দিচ্ছি আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে। আমরা আমাদের বাংলা ভাষা না পৌঁছে দিয়ে বিদেশি ভাষাকে কেন গুরুত্ব দিচ্ছি?

হয়তোবা কোনো এক সময়ে দেখা যাবে, বাংলা বিলুপ্তপ্রায় এক ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনকার সমাজে এসে ছোটবেলা থেকেই ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী করার জন্য সেই বাচ্চার পেছনে ছুটে চলেছেন বাবা-মায়েরা, আবার অনেক শিক্ষার্থী ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। তাহলে আমাদের বাংলা ভাষার মর্যাদা ও বাংলা ভাষা চর্চার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তা না হলে বাংলা ভাষা গুরুত্বহীন ভাষা হিসেবে দাঁড়িয়েছে কেন?

আমাদের বাংলা ভাষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষাকে তুলে ধরতে হবে বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে। আমাদের দেশপ্রেম কতটুকু, এটা নিয়েও সংশয় থেকে যায়, যেখানে বাংলা ভাষার প্রতি এতটাই অনীহা। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে লক্ষ করলে দেখতে পাবেন, বাঙালিরা হিন্দি শিখছে ওদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য। কিন্তু কোনো হিন্দিভাষীকে বাংলা শিখতে দেখবেন না।

অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর ভারতের এক রিয়্যালিটি শোতে গিয়ে বলেছিলেন বাংলা ভাষার প্রতি প্রতিবাদ করে, ‘অগর হাম লোগ হিন্দি বোল সকতে হ্যায়, তো আপ কিউ বেঙ্গলি নহি শিখ সকতে?’ বাংলায় যার অর্থ, ‘আমরা হিন্দি শিখে কথা বলতে পারলে আপনারা বাংলা শিখতে পারেন না কেন?’

এর বাইরে আমরা বিভিন্ন ভাষায় গান, চলচিত্র ইত্যাদি দেখার সময় ওই ভাষা না বুঝলেও কেবল শব্দ আর ওদের আকার-ভঙ্গি দেখে বিনোদন উপভোগ করছি। কিন্তু কেন?

কলকাতায় বাংলা ভাষা মরতে বসেছে আর বাংলাদেশে আধমরা হয়ে বসে আছে। কারণ, কলকাতায় হিন্দি ও ইংরেজি শব্দের প্রচলন তুলনামূলক বেশি না হলে তারা তাদের ‘স্মার্টনেস’ ধরে রাখতে পারছে না।

আজকাল রেডিও স্টেশনে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি মিশিয়ে এটি যেন খিচুড়ির রন্ধনপ্রণালি। কোনো রেস্তোরাঁ, অফিস, আদালতে বাংলা ভাষার সঙ্গে কিছু ইংরেজি শব্দ মিশিয়ে আমরা আলাপচারিতা করছি।

তাহলে কি আমাদের বাংলা ভাষার পিঠ ঠেকে গিয়েছে দেয়ালে, যে বাংলা ভাষায় আমাদের নিজেদের কথা তুলে ধরতে এত অনীহা। তাই দায়বদ্ধতা থেকে হলেও মাতৃভাষাকে ধরে রাখতে সাবলীলভাবে বাংলা বলতে শিখুন, বাংলাকে ভালোবাসুন।

  • সৌরভ হালদার
    শিক্ষার্থী, ব্যবস্থাপনা বিভাগ
    সরকারি ব্রজলাল কলেজ, খুলনা