চিত্রা নদীর ইলিশ যেন কল্পকাহিনি

ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। বাঙালির কাছে ইলিশ খুব জনপ্রিয়। মূলত এটি একটি সামুদ্রিক মাছ। সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে এদের ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা যায়। এগুলো মিঠাপানিতে ডিম পাড়তে আসে। ডিম থেকে রেণু বের হলে বৃদ্ধি ও পরিপক্বতার জন্য সেগুলো আবার সমুদ্রে চলে যায়। বাংলাদেশের উপকূলবর্তী নদী, যেমন পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তেঁতুলিয়া, শিবসা নদীগুলোর মোহনার কয়েকটি স্থানকে এগুলোর ডিম ছাড়ার ক্ষেত্র হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলো সাধারণত জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের প্রজনন ঘটায়।

বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা নদীর নিচের অংশ, রুপসা, শিবসা, বিষখালী, তেঁতুলিয়া, আড়িয়াল খাঁ ও পশুরে প্রচুর ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। ইলিশ দেশের মোট উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ ভাগ ও সামুদ্রিক মাছের প্রায় ৪১ ভাগের বেশি। এ ছাড়া পুরো বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। অর্থাৎ বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনে ৭৫ ভাগই বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়।

ইলিশ মাছ অর্থনৈতিক দিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আহরিত মাছের একটা বড় অংশ স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয়। এ ছাড়া চাহিদা বেশি থাকায় বিদেশে, বিশেষ করে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ইলিশ রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়ে থাকে।

নদীতে পলি জমে উপরিভাগ শুকিয়ে যাওয়া, ব্যাপক আকারে জাটকা নিধন ইলিশ মাছের সংখ্যা বৃদ্ধির সম্ভাব্য অন্তরায়। এ ছাড়া ভারতের গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ ইলিশের উৎপাদন কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। আশার কথা, বর্তমান সরকার ইলিশসম্পদ টিকিয়ে রাখতে বছরের কিছু নির্দিষ্ট সময় ইলিশ মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা, জাটকা নিধন বন্ধ ও ডিমওয়ালা ইলিশ রক্ষার্থে প্রণীত মৎস্য আইন প্রয়োগে বহুবিধ ব্যবস্থা নিয়ে আশানুরূপ ফল পাওয়া গেছে। এর ফলে মাছের আকার ও উৎপাদন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।

ইলিশ মাছের ধর্ম স্রোতের বিপরীতে সাঁতরানো। আর জাল গড়া দেওয়ার সময় জালে ধরা পড়ত বিভিন্ন সাইজের রুপালি ইলিশ। যেসব লোকের নিজস্ব নৌকা–জাল ছিল না, তাঁরা অন্য লোকের নৌকা–জাল দিয়ে মাছ ধরে তা মালিকের সঙ্গে আধাআধি ভাগ করে নিত। মায়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম, এ রকম নৌকা–জালের মালিক হিসেবে আমরা একদিন আধাআধি ভাগে বিভিন্ন সাইজের ২২টি ইলিশ মাছ পেয়েছিলাম

বর্তমান সময়ে বাঙালির এই অতি প্রিয় ইলিশের আকাশছোঁয়া দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। যেমন ১ কেজির একটা ইলিশের দাম ১৫–১৬ শত টাকা, যা একজন সাধারণ মানুষ কেনার কথা চিন্তাই করতে পারে না। উল্লেখ্য, এমন এক সময় ছিল, যখন বাংলাদেশের ছোট–বড় অনেক নদীতে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যেত। যেমন আমাদের নড়াইলের চিত্রা নদীতে পঞ্চাশ–ষাটের দশকে আমাদের শৈশবে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ত।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে যে কয়টি গুরুত্ব পূর্ণ নদী আছে, চিত্রা তার অন্যতম। নড়াইল শহরের পাশ দিয়ে এই নদীর প্রবাহ। নদীটি চুয়াডাঙ্গা ও দর্শনার নিম্নস্থল থেকে উৎপন্ন হয়ে মাগুরা ও ঝিনাইদহর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নড়াইলে প্রবেশ করে নবগঙ্গা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে আর মাইজপাড়া থেকে উত্তরে মাগুরার সঙ্গেও নবগঙ্গা নামে মিলিত হয়েছে।

পঞ্চাশ-ষাটের দশকে আমাদের চিত্রা নদীতে প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পড়ত। সে সময় নদীর পার্শ্ববর্তী গ্রামের মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের লোকেরা ডিঙিনৌকায় করে সাইংলেজাল দিয়ে নদীতে ইলিশ মাছ ধরত। ইলিশ মাছ ধরার এই জাল আমাদের নড়াইলের স্থানীয় ভাষায় সাইংলেজাল নামে পরিচিত। তাঁরা ডিঙিনৌকা থেকে এই গভীর নদীতে জাল ফেলে উজান থেকে ভাটির দিকে জাল গড়া দিত (আমাদের নড়াইলের স্থানীয় ভাষায় জাল ফেলে উজান থেকে ভাটিতে যাওয়া গড়া নামে পরিচিত)।

ইলিশ মাছের ধর্ম স্রোতের বিপরীতে সাঁতরানো। আর জাল গড়া দেওয়ার সময় জালে ধরা পড়ত বিভিন্ন সাইজের রুপালি ইলিশ। যেসব লোকের নিজস্ব নৌকা–জাল ছিল না, তাঁরা অন্য লোকের নৌকা–জাল দিয়ে মাছ ধরে তা মালিকের সঙ্গে আধাআধি ভাগ করে নিত। মায়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম, এ রকম নৌকা–জালের মালিক হিসেবে আমরা একদিন আধাআধি ভাগে বিভিন্ন সাইজের ২২টি ইলিশ মাছ পেয়েছিলাম। মুরব্বিদের কাছে আরও শুনেছি, ওই সময় ইচ্ছা করে কেউ রোজ নদীতে মাছ ধরতে যেত না, শুধু বাসায় মেহমান এলে নদীতে জাল গড়া দেওয়া হতো। ওই সময় বিষয়টা অনেকটা এই রকম ছিল যে ইলিশ মাছ যেন পুকুরে জিয়ানো রয়েছে। ইচ্ছা করলে ধরলাম, ইচ্ছা করল না তো ধরলাম না। বর্তমান প্রজন্মের কাছে বিষয়টি কল্পকাহিনি বলে মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক।

মো. নজমুল হক
সাবেক উপপ্রধান পরিদর্শক (সাধারণ)
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর,
ঢাকা বিভাগ, ঢাকা।