আমি দেশের নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করি। এখন আমি ইতালির একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করছি। পাশাপাশি ইরাসমাস স্টাডি এক্সচেঞ্জ বৃত্তির অধীনে পোল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব ভ্রোস্লাভেও পড়াশোনা করছি। আমার এই লেখার মাধ্যমে ইতালিতে উচ্চশিক্ষার যাত্রা এবং বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের ইতালিতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ-সুবিধা সবার কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করব।
উচ্চশিক্ষায় ইতালি কেন?
বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ, বৃত্তিসহ পড়াশোনা এবং নামমাত্র পড়াশোনার খরচ—এসব বিষয় মাথায় রাখলে ইতালি হতে পারে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য উত্তম গন্তব্য। ইতালিতে উচ্চশিক্ষার জন্য ইতালীয় সরকার বিভিন্ন ধরনের বৃত্তি প্রদান করে থাকে, প্রায় শতভাগ পর্যন্ত এসব বৃত্তি শিক্ষার্থীরা পেয়ে থাকে। যার পরিমাণ বৃত্তিভেদে বাৎসরিক প্রায় ৬ হাজার ৫০০ থেকে ১০ হাজার ইউরো হয়ে থাকে। যা দিয়ে একজন শিক্ষার্থী সহজেই নিজের জীবনযাত্রা চালিয়ে নিতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনা করলে শিক্ষার্থীদের কাছে ইতালি নিঃসন্দেহে একটি ভালো গন্তব্য।
ইতালির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তথ্য কীভাবে পেতে পারি?
ইতালিতে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি করার সুযোগ রয়েছে। একজন শিক্ষার্থী ইন্টারনেট থেকে খুঁজে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবসাইট থেকে আবেদন করার যোগ্যতা এবং প্রয়োজনীয় সব তথ্য পেতে পারে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং পছন্দের বিষয় খুঁজে পেতে পারে নিম্নের ওয়েবসাইটগুলো থেকে: স্নাতকের জন্য: www.bachelorsportal.com
। স্নাতকোত্তরের জন্য: www.mastersportal.com
কখন আবেদন করতে হয় এবং কী প্রস্তুতি নিতে হয়?
সাধারণত বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ইতালিতে একটাই শিক্ষাবর্ষ হয়ে থাকে, যা শুরু হয় সেপ্টেম্বর থেকে। আর এর জন্য আবেদনপ্রক্রিয়া শুরু হয় সাধারণত জানুয়ারি থেকে এবং চলে মে পর্যন্ত। তবে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এর আগে বা পরেও হয়ে থাকে।
নিজের পছন্দের বিষয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে এরপর প্রয়োজনীয় তথ্য এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করতে হবে। এরপর সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে আবেদন করা যাবে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের জন্য কোনো ফি দিতে হয় না। আবার কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের জন্য ২০-৪০ ইউরো লেগে থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদনের সময় সাধারণত নিম্নোক্ত জিনিস লেগে থাকে—পাসপোর্ট, একাডেমিক সনদ, একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট, ভাষা যোগ্যতার সনদ, সিভি, মোটিভেশন লেটার, রিকমেন্ডেশন লেটার ইত্যাদি।
নিজেকে যেভাবে যোগ্য করে তুলতে হবে
ইতালিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে অফার লেটার পেলেই যে ইতালিয়ান অ্যাম্বাসি ভিসা দিয়ে দেবে—এমনটা নয়। তাই ভিসা আবেদনের সময় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঠিকভাবে জমা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। যেমন কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আইইএলটিএস ছাড়াও শিক্ষার্থীদের গ্রহণ করে। কিন্তু দেখা যায়, অ্যাম্বাসি তাকে ভিসা দেয় না। সে ক্ষেত্রে আইইএলটিএস স্কোর কমপক্ষে ৬ থাকাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
পড়াশোনার পাশাপাশি কাজের সুযোগ-সুবিধা
ইতালিতে পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন কাজ করার সুযোগ রয়েছে। খণ্ডকালীন কাজ পেতে ইতালিয়ান ভাষার দক্ষতা অনেক সাহায্য করে। তাই ইতালিয়ান ভাষায় দক্ষতা অর্জন অত্যন্ত জরুরি। এখানে বিনা খরচে ইতালিয়ান ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। (এখানে একটা বিষয়ে মনে রাখতে হবে, কোনো শিক্ষার্থী যদি ঠিকমতো পড়াশোনা করে, তাহলে সে যে পরিমাণ বৃত্তির টাকা পাবে, তা একজন শিক্ষার্থীর জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট। কাজ না করেও একজন শিক্ষার্থী নিজেকে চালিয়ে নিতে পারবে অনায়াসেই। তাই শিক্ষার্থীর জীবনধারনের জন্য কাজের ওপর নির্ভর করতে হবে না।)
ইতালিতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি এখনো বাংলাদেশি অনেক শিক্ষার্থী বা অভিভাবক জানেন না। যার কারণে অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক দেশের এডুকেশন এজেন্সিদের শরণাপন্ন হয়ে থাকেন। আর এই সুযোগ গ্রহণ করে অসাধু এজেন্সির মালিকেরা একটা মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে থাকে। অথচ ইতালিতে উচ্চশিক্ষার জন্য ভিসা পাওয়া পর্যন্ত সামান্য খরচ হয়ে থাকে।
যে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে
ইতালিতে উচ্চশিক্ষার জন্য কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না। এর মানে একজন শিক্ষার্থী সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে পারে। এরপর কোনো শিক্ষার্থী অফার লেটার পেলে ওই বিশ্ববিদ্যালয় সব নির্দেশনা ই-মেইলের মাধ্যমেই দিয়ে থাকে। যেমন প্রি-এনরোলমেন্ট, স্কলারশিপ, ভিসা আবেদন ইত্যাদি বিষয়ের যাবতীয় নির্দেশনা ই-মেইলের মাধ্যমেই তারা প্রদান করে থাকে।
বেশির ভাগ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী যে ভুল করে থাকে
বাস্তবতা হচ্ছে, ইতালিতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি এখনো বাংলাদেশি অনেক শিক্ষার্থী বা অভিভাবক জানেন না। যার কারণে অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক দেশের এডুকেশন এজেন্সিদের শরণাপন্ন হয়ে থাকেন। আর এই সুযোগ গ্রহণ করে অসাধু এজেন্সির মালিকেরা একটা মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে থাকে। অথচ ইতালিতে উচ্চশিক্ষার জন্য ভিসা পাওয়া পর্যন্ত সামান্য খরচ হয়ে থাকে। এর পাশাপাশি এজেন্সির লোকেরা অদক্ষ হওয়ার কারণে তারা সঠিকভাবে শিক্ষার্থীদের প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করতে পারে না। যার ফলে অনেক শিক্ষার্থী ইতালি আসতে পারলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না এবং অনেকে বৃত্তি হারিয়ে বিপদে পড়ে। শেষে অনেক ছাত্র-ছাত্রী ঝরে পড়ে পড়াশোনা থেকে।
অসাধু এজেন্সির হাত থেকে রেহাই উপায়
প্রথমেই মনে রাখতে হবে, ইতালিতে উচ্চশিক্ষার সব প্রক্রিয়া একজন শিক্ষার্থী অনায়াসেই করতে পারে। গত দুই বছরে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ শিক্ষার্থী ইতালিতে উচ্চশিক্ষার জন্য এসেছে। তারা ফেসবুক গ্রুপ খুলে বিভিন্ন ধরনের তথ্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের জানিয়ে থাকে। এ ছাড়া অনেক শিক্ষার্থী ইউটিউবে ভিডিওর মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য জানিয়ে থাকে।
একটি সাহায্যকারী ফেসবুক গ্রুপ হচ্ছে: https://facebook.com/groups/340898109373590/
যেকোনো শিক্ষার্থী ওই ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত হয়ে যেকোনো প্রশ্ন করে পোস্ট করলে ইতালিতে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা তথ্য দিয়ে সাহায্য করে থাকে।
এভাবেই তথ্য সংগ্রহ করে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এজেন্সির প্রতারণা থেকে রেহাই পেতে পারে।
সবশেষে যে কথা মনে রাখতে হবে
অতীতের বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, ইতালিতে ভিসা করিয়ে দেওয়ার নাম করে অনেক প্রতারক মাঠে কাজ করে। বাস্তবিক অর্থে এর কোনো ভিত্তি নেই। কেউ এমন ধরনের প্রলোভন দেখালে বা ভয়ভীতি প্রদর্শন করলে সরাসরি পুলিশের শরণাপন্ন হতে হবে।
মো. মঈদুল ইসলাম নোমান ইতালির ইউনিভার্সিটি অব ইস্টার্ন পিয়েমন্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল বায়োটেকনোলজি বিষয়ে স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত।