চাকরি নয়, মানুষ হয়ে গড়ে ওঠাই হোক লেখাপড়ার উদ্দেশ্য

মানুষ জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই মনুষ্যত্বের বোধ উপলব্ধি করতে পারে না, তা জাগিয়ে তুলতে হয়। তার একটি মাধ্যম শিক্ষা অর্জন বা লেখাপড়া। লেখাপড়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের বিবেচনাবোধ জাগিয়ে তুলতে পারি, জ্ঞান অর্জন করে তা চলার পথে প্রয়োগ করতে পারি, জানতে পারি ন্যায়-অন্যায়, সঠিক-ভুল, ভালো-খারাপের মধ্যে তফাত কী। লেখাপড়ার মূল উদ্দেশ্য এসব হলেও বর্তমানে তা সনদ অর্জনের হাতিয়ার ছাড়া আর কিছুই নয়।

ভবিষ্যতে ভালো চাকরি পেতে হবে, এমন লক্ষ্য মাথায় রেখেই পড়ালেখা করে মানুষ, যা গৎবাঁধা পাঠ্যপুস্তক পড়া এবং সেটা পরীক্ষার খাতায় ঢেলে দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বইয়ের পাতায় কী বলছে, তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার তাগিদ বা তাড়না—কোনোটাই আমাদের নেই। এই যেমন সদা সত্য কথা বলবে, মিথ্যা সকল পাপের মা। এগুলো পাঠ করে এবং পরীক্ষার খাতায় লিখে সনদ অর্জন ব্যতীত এর বাস্তব চর্চা কেউ করে না। কারণ, তার কাছে ভবিষ্যতের কর্মসংস্থানের চিন্তাই দৃঢ়। ফলে মানুষ হিসেবে গড়ার চেয়ে চাকরিজীবী বা পেশাগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়াটাই তখন লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, যার দরুন মানুষের মধ্যে দেখা দেয় মূল্যবোধের অভাব, সংকীর্ণ মানসিকতা, মনুষ্যত্বহীনতা। এসব কারণে মানুষ খুব সহজে নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে নানা অপকর্ম বা অনৈতিক কর্মে জড়িয়ে পড়ে।

একটি শিশুর ভেতরে এটি ঢুকিয়ে দেওয়া হয় না, কীভাবে সে তার ভেতরের প্রতিভা জাগ্রত করবে, কীভাবে সে প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে; বরং তার ভেতরে এই ভাবনা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, কীভাবে সে টাকা উপার্জন করে পরিবারকে টিকিয়ে রাখবে। তা ছাড়া গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের পড়াশোনা দ্রুত বন্ধ করে দেওয়া হয়, যার মূল কারণ তারা অর্থনৈতিক দিক থেকে পরিবারে অবদান রাখতে পারবে না, তাই ছেলেদের পড়াশোনায় জোর দেওয়া হয়, যার উদ্দেশ্য একমাত্র চাকরি।

১০০ শিক্ষার্থীকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, তোমাদের পড়ালেখা করার উদ্দেশ্য কী? তাদের মধ্যে ৯৮ শতাংশ বলবে, ভবিষ্যতে একটা ভালো চাকরি পাওয়া। বাকি ১ শতাংশ বলবে, ‘শিক্ষিত’ শব্দের ট্যাগ লাগানোর জন্য আর ১ শতাংশ বলবে, জ্ঞান অর্জন করার জন্য। কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে চাকরি বা অর্থনৈতিক লাভ, যাকে ঘিরেই আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসা–যাওয়া।

আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো চায় না, তারা যে রকম অর্থসংকটের মধ্য দিয়ে গেছে, তাদের সন্তানেরা সেটার মধ্য দিয়ে যাক এবং তার একমাত্র সমাধান হিসেবে তারা বেছে নেয় লেখাপড়া করে ভালো চাকরি করা।

আমাদের লেখাপড়ার দরকার আছে, শিক্ষিত হওয়ারও প্রয়োজন আছে। তবে যেটা জীবিকা নির্বাহের জন্য লেখাপড়া করা হয়, সেটা আসলে লেখাপড়া নয়। সেটাকে এক প্রকার ট্রেনিং নেওয়া বা দক্ষতা অর্জন করা বলা যেতে পারে।

মনুষ্যত্ব বিকাশ, মূল্যবোধ অর্জন এবং নৈতিক শিক্ষা অর্জনের জন্য যে লেখাপড়া করা হয়, সেটাই আসল শিক্ষা। আমার মতে, নৈতিক শিক্ষাই একমাত্র এবং ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র মেরুদণ্ড বিনির্মাণে প্রধান শিক্ষা। এ বিষয়ে লেখাপড়া করার প্রয়োজন আছে। নৈতিক শিক্ষা না থাকলে একজন প্রকৌশলী রডের পরিবর্তে বাঁশ দেবেন, চিকিৎসক বিনা প্রয়োজনে হাজার হাজার টাকার টেস্ট করতে বলবেন। সরকারি চাকরিজীবী ফাইল আটকে রেখে ঘুষ খাবেন।

একটা দেশকে এগিয়ে নেওয়া, সুন্দর সমাজ গড়া, মানবসেবা করাই লেখাপড়ার মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। তাতে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি হবে না। দেশের ক্ষতি করার দিকে নিজেকে নিয়ে যাবে না।

ইসরাত জাহান
লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]