‎পরীক্ষার ফলের মাধ্যমেই মেধার মূল্যায়ন না হোক

চিঠিপ্রতীকী ছবি

‎আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের একটা বড় সমস্যা, কোনো শিক্ষার্থী পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেলে তাকে মেধাবী ছাত্র হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। স্বাভাবিকভাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে, সে মেধা খাটিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করে পড়াশোনার মাধ্যমে ভালো ফল অর্জন করেছে। তবে কেবল জিপিএ-৫ পেলে কোনো শিক্ষার্থী মেধাবী হতে পারে না। যারা ভালো ফল অর্জন করতে পারেনি অথবা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে, তাদের মধ্যেও কিন্তু অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী লুকিয়ে থাকে। অনেক সময় শামুকের পেটেও হীরা-মুক্তা পাওয়া যায়।

‎পড়াশোনায় অমনোযোগিতা ছাড়াও দরিদ্রতা, ভালো গাইডেন্সের অভাব, শিক্ষক ও অভিভাবকের অবহেলার কারণে প্রতিবছর অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়। কেউ কেউ অকৃতকার্য হওয়ার পর মানুষের কটূক্তির কারণে আত্মহত্যার মতো পথ বেঁচে নেয়। কেউ কেউ মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে এবং পরবর্তী সময়ে পড়াশোনার প্রতি তাদের মন উঠে যায়। এর জন্য অনেকাংশে দায়ী অভিভাবক ও শিক্ষকেরাও।

অন্যদিকে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া বা ভালো ফল অর্জন করতে না পারা শিক্ষার্থীদের মনে রাখতে হবে—বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনও উচ্চমাধ্যমিকে অকৃতকার্য হয়েছিলেন। দুবার পরীক্ষা দিয়ে তাঁকে পাস করতে হয়েছে। শৈশবে আলবার্ট আইনস্টাইনকে একবার তাঁর মা বাজারে পাঠিয়েছিলেন কিছু পণ্য কেনার জন্য, তিনি বাজারে যাওয়ার পর সবকিছু ভুলে যান। নিজের নামটাও তিনি পণ্য বিক্রেতাকে বলতে পারেননি সেদিন। কিন্তু সেই আলবার্ট আইনস্টাইন পরবর্তী সময়ে হয়ে উঠেছেন বিশ্বের এক নম্বর বিজ্ঞানী। যাঁকে নিয়ে বিশ্বের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে পড়ানো হয়, তাঁর অর্জন নিয়ে গবেষণা হয়। তাঁকে স্যালুট জানানো হয়। বিশ্বের এক নম্বর যে বিজ্ঞানী শৈশবে নিজের নাম বলতে ভুলে যান, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করতে দুবার পরীক্ষা দিতে হয়, সেই বিজ্ঞানী একসময় বদলে দিয়েছেন পৃথিবীর সময়ের ধারণাকে। আবিষ্কার করেছেন থিওরি অব রিলেটিভিটি (আপেক্ষিকতার তত্ত্ব)। তাহলে আইনস্টাইন কি মেধাবী নন! মনে রাখতে হবে, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া মানে ব্যর্থতা নয়, বরং আরও অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ হওয়া, আরও সাহসী ও উদ্যমী হওয়া।

বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের মধ্যে আলবার্ট আইনস্টাইনের পরে যাঁর নাম আসবে, তিনি স্টিফেন হকিং। যিনি শেষ জীবনে পঙ্গুত্বের সঙ্গে কাটিয়েছেন, বাক্শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন, হাঁটতে পারতেন না, দুই হাত অবশ হয়ে যেত, সেই স্টিফেন হকিং গবেষণার মাধ্যমে গভীর ধারণা দিয়েছেন ‘ব্ল্যাক হোল’ সম্পর্কে। প্রমাণ করেছেন, ব্ল্যাক হোল একদম কালো নয়, কোয়ান্টাম প্রভাবের কারণে ব্ল্যাক হোল থেকে ধীরে ধীরে বিকিরণের মাধ্যমে তাপ বের হয়।

এ ছাড়া স্টিফেন হকিং ইউনিফায়েড থিওরির ধারণা ও মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি গবেষণা করতেন হুইলচেয়ারে বসে যোগাযোগযন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে। যদি একজন মানুষ শেষ জীবনে এসে পঙ্গু হয়েও গবেষণা চালিয়ে যেতে পারেন আর পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে গভীর ধারণা দিতে পারেন, তাহলে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা একবার অকৃতকার্য হয়ে পুনরায় উঠে দাঁড়াতে পারবে না কেন! তাদের উঠে দাঁড়াতে সবার আগে শিক্ষকদের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। মা–বাবাকে অনুপ্রেরণা জোগাতে হবে। শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে—কেবল পরীক্ষার ফলাফলের মাধ্যমে মেধার মূল্যায়ন হয় না।

মনে রাখতে হবে, সৃষ্টিকর্তা সবাইকে সবকিছুতে পরিপূর্ণতা দিয়ে সৃষ্টি করেননি। সবাইকে কোথাও না কোথাও দুর্বলতা দিয়েছেন। আমাদের সবাইকে সেই দুর্বলতা খুঁজে বের করে শক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। ভয়কে জয় করতে হবে। শিক্ষার্থীরা একবার পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে মানে তার জীবন ব্যর্থ হয়ে গেছে, এমনটা মনে করা যাবে না। বরং পরবর্তী সময়ে ব্যর্থতাকে জয়ী করার সাহস জোগাতে হবে।

কিছু শিক্ষার্থী ভালো লেখালেখি করতে পারে, কিন্তু তেমন কথা বলতে পারে না, বক্তৃতা দিতে পারে না। আবার অনেকেই খুব ভালো করে কথা বলতে পারে, কিন্তু লিখতে পারে না। সবার প্রতিভা ভিন্ন রকম হলেও সৃষ্টিকর্তা সবাইকে সমান মেধা দিয়েছেন। কেউ কেউ সেই মেধাকে কাজে লাগায় পরিশ্রম ও গবেষণার মাধ্যমে, আর কেউ কেউ হাল ছেড়ে দেয়। যারা কাজে লাগায়, তারা বিজ্ঞানী হয়ে উঠতে পারে। আর যারা হাল ছেড়ে দেয়, তাদের জীবন অন্ধকারে ডুবে থাকে। ক্লাসের ফার্স্ট বেঞ্চ থেকে লাস্ট বেঞ্চের শিক্ষার্থী—সবাই সমান মেধার অধিকারী। শিক্ষকেরা সব শিক্ষার্থীকে সমান চোখে দেখলেই সবাই মেধাবী হয়ে উঠতে পারে। একজন শিক্ষার্থীকে মেধাবী হিসেবে গড়ে তুলতে পরিবারের সহযোগিতাও প্রয়োজন হয়। আর প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে সমাজের কটূক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গিকে পাশ কাটিয়ে আসতে হবে। তাহলেই সফলতার আলো বুকে এসে জড়িয়ে ধরবে।

আবদুল্লাহ নাজিম আল মামুন

শিক্ষক, অন্বেষা মডেল স্কুল

কুতুবদিয়া, কক্সবাজার