তারুণ্যের শক্তি হতে পারে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সম্পদ

সুমন স্নাতকোত্তর শেষ করে বাসায় বসে আছেন। সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে এখন তিনি ক্লান্ত। কোথায়ও তাঁর চাকরি হচ্ছে না। পরিবার ও সমাজের কটু কথার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাঁর দিন। একসময় তাঁর কাছে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা হয়ে ওঠে কষ্টকর। তাই তিনি সমাজ ও পরিবার ছেড়ে চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকায় এসে কী করবেন বুঝতে পারেন না। পরিচিত এক ভাই তাঁকে পরামর্শ দেন ফ্রিল্যান্সিং কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে। ছয় মাস কষ্ট করে ফ্রিল্যান্সের একটি কোর্স করার জন্য বললেন।

সুমন কী করবেন? তাঁর ভবিষ্যৎ কী হবে? কী করলে তাঁর ভালো একটা ক্যারিয়ার হবে? অতঃপর সেই ভাইয়ের পরামর্শে তিনি একটি আইটি প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল মার্কেটিং কোর্সে ভর্তি হয়ে যান। ছয় মাস কষ্ট করার পর এখন সুমন নিজে একজন আইটি উদ্যোক্তা। এখন তিনি ঘরে বসে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, চীন ও জাপানের মতো দেশের বিখ্যাত ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করছেন।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ছোঁয়ায় বিশ্ব এখন বদলে যাচ্ছে। শিল্পের কাঠামো ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সার্বিক, আমূল ও আকস্মিক পরিবর্তনের সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সম্মিলিত রূপই শিল্পবিপ্লব।

প্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। বিদ্যুৎ আবিষ্কার হয় ১৮৭০ সালে; ফলে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব ত্বরান্বিত হয় এবং তৃতীয় শিল্পবিপ্লব ঘটে ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেট আবিষ্কারের মাধ্যমে। ইন্টারনেটের আবিষ্কার শিল্পবিপ্লবের গতি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। তবে আগের তিনটি শিল্পবিপ্লবকে ছাড়িয়ে গেছে আজকের যুগের ডিজিটাল বিপ্লব, যাকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।

ডিজিটাল বিপ্লবকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হিসেবে প্রথম সংজ্ঞায়িত করেন ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের চেয়ারম্যান ক্লাউস সোয়াব তাঁর লেখা ‘দ্য ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন’ গ্রন্থে।

২০১৬ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত এ গ্রন্থে তিনি চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। পরবর্তী সময়ে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এ ধারণার ব্যাপক প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেয়। তারও আগে ২০১১ সালে একদল জার্মান বিজ্ঞানী শিল্প–কলকারখানাগুলোয় কীভাবে অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করা যায় বা ডিজিটাল কৌশল প্রয়োগ করা যায়, তা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। যেখানে কম জনবল দিয়ে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে পণ্য উৎপাদন সহজ হবে। সেখান থেকেই মূলত চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ধারণাটির উদ্ভব।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই তরুণ। এ দেশের কর্মসংস্থানেও তারুণ্যের ভূমিকা রয়েছে অসামান্য। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের মতে, তরুণ জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ভারতে ৩৫ কোটি ৬০ লাখ, চীনে ২৬ কোটি ৯০ লাখ, ইন্দোনেশিয়ায় ৬ কোটি ৭০ লাখ, যুক্তরাষ্ট্রে ৬ কোটি ৫০ লাখ, পাকিস্তানে ৫ কোটি ৯০ লাখ এবং বাংলাদেশে রয়েছে ৪ কোটি ৭৬ লাখ। এই তরুণেরাই বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে চলেছেন। ইতিহাস সৃষ্টি থেকে প্রতিটি স্তরে সেই তরুণ যুবকেরাই জোগান দিয়েছিলেন। আজও বাংলাদেশের সব অভূতপূর্ব সৃষ্টিগুলোর জন্মই দেন তরুণেরা। মুক্তিযুদ্ধের সময় ও যুদ্ধ–পরবর্তী দেশ গঠনেও তরুণদের ছিল ইতিবাচক ভূমিকা।

গান, কবিতা, আবৃত্তি, নাচ, খেলাধুলা, সাহিত্য–আড্ডা, ছাত্ররাজনীতি—সবকিছুতে তাঁদের ছিল প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের সব ক্ষেত্রে চরম দৈন্য লক্ষণীয়। না আছে খেলার মাঠ, না আছে পৃষ্ঠপোষক, না আছে সাহিত্য-আড্ডা, না আছে সুস্থধারার সাংস্কৃতিক আন্দোলন। তথ্যপ্রযুক্তি, বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণাতেও আমরা অনেক পিছিয়ে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) আঞ্চলিক কর্মসংস্থান নিয়ে প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশে এ হার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, যা এ অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। দেশে তরুণদের, বিশেষত শিক্ষিত তরুণদের এক বৃহদাংশ বেকার জীবন যাপন করছেন এবং সেটা বেড়েই চলছে।

বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা তিন কোটি। প্রতিষ্ঠানটি আভাস দিয়েছে, কয়েক বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে ছয় কোটিতে দাঁড়াবে, যা মোট জনসংখ্যার ৩৯ দশমিক ৪০ শতাংশ হবে। আইএলওর হিসাবটিকেই পর্যবেক্ষকেরা বাংলাদেশের প্রকৃত বেকারের সংখ্যা বলে মনে করেন।

২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, বাংলাদেশে ৪৭ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত হয় বেকার, নয়তো তিনি যে কর্মে নিযুক্ত এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজন ছিল না। প্রতিবছর বাংলাদেশে ২২ লাখ কর্মক্ষম মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করছেন। এই বিশালসংখ্যক কর্মক্ষম মানুষের মাত্র সাত শতাংশ কাজ পাবেন। এর অর্থ হচ্ছে, দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বেকারের তালিকায় নাম লেখাচ্ছেন।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে মাথায় রেখে দেশের এই বিপুলসংখ্যক তরুণ বেকারদের যদি আমরা আইসিটি সেক্টরে দক্ষ করে তুলতে পারি, তাহলে তাঁরা হয়ে উঠবেন একেকজন দেশের সম্পদ। সুমনের মতো বেকার যুবকেরা হয়ে উঠবেন সমাজের ও পরিবারের গর্ব করার বিষয়।

এখনই সময় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কারিকুলাম প্রণয়নের সময় চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে মাথায় রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এআই, সাইবার সিকিউরিটি, রোবোটিকস ইত্যাদি বিষয়গুলোর গুরুত্ব বাড়ানো হোক।

বর্তমান তরুণ প্রজন্ম কাজে বিশ্বাস করে, কথায় নয়। আজ আমাদের দেশে গড় তরুণ বেকারের সংখ্যা অন্য দেশের তুলনায় অধিক। এই বেকার তরুণদের চিন্তাচেতনা আর বুদ্ধি যদি কাজে লাগাতে পারে রাষ্ট্র, তবে বাংলাদেশ পরিণত হবে সোনার বাংলায়। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে তরুণ সমাজের বিকল্প নেই।

মো. হাসনাইন রিজেন

শিক্ষার্থী, হাটহাজারী সরকারি কলেজ,

হাটহাজারী, চট্টগ্রাম