যেভাবে শিশু-কিশোরেরা পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে

সময়টা বেশি দূরের নয়; আজ থেকে দুই যুগ পেছনে গিয়ে আমরা আমাদের বাল্যকাল ও কৈশোরের দিকে যদি তাকাই, তাহলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সোনালি দিনগুলো। বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে পাড়ার মাঠে খেলতে যাওয়া, খেলা শেষে পুকুরে দাপাদাপি করে চোখ লাল করে বাড়িতে ফেরা, চৈত্রের দুপুরে মায়ের নিষেধ অমান্য করে ঘুরতে বের হওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে বৌছি, গোল্লাছুট, মার্বেলসহ বিভিন্ন খেলায় মজে থাকাসহ কতভাবে পার করেছিলাম শৈশব।

কিন্তু যতই সময়ের পরিবর্তন হতে লাগল, ততই বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে আমাদের সমাজের পরিবর্তন হতে শুরু করে। আমাদের শিশু-কিশোরেরা ইন্টারনেট, কম্পিউটার ও স্মার্টফোনের মধ্যেই বুঁদ হতে লাগল। তারা বাইরে খেলাধুলা ও বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার চেয়ে ইন্টারনেটে, মুঠোফোন ও কম্পিউটারে বেশি সময় দিতে শুরু করে। যার ফলে তারা ধীরে ধীরে হারাতে শুরু করে তাদের বর্ণিল শৈশব ও কৈশোর।

শিশু-কিশোরেরা ইন্টারনেট, কম্পিউটার ও স্মার্টফোনে বুঁদ হয়ে থাকায় ধীরে ধীরে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হতে শুরু করে। এর ফলে তারা নানা ধরনের যৌনাচরণে অভ্যস্ত হয়ে যায়। রিটি টেকনোলজি কোম্পানি বিটডিফেন্ডারের গবেষণা অনুযায়ী, পর্ন সাইটে যাতায়াত করা প্রতি ১০ জনের মধ্যে ১ জনের বয়স ১০ বছরের নিচে। আর এই অল্প বয়সী বাচ্চাগুলো রেপ পর্নজাতীয় ভয়াবহ সব ক্যাটাগরির পর্ন দেখছে। অন্যদিকে, এনএসপিসিসি চাইল্ডলাইনের সাম্প্রতিক সময়ের জরিপ অনুসারে, ১২ থেকে ১৩ বছর বয়সীদের মধ্যে শতকরা ১০ জন এই ভেবে ভীত যে তারা পর্নে আসক্ত হয়ে পড়েছে। তারা মনে করছে, চাইলেও আর পর্ন দেখা বন্ধ করতে পারবে না।

ইউএনডিপি বাংলাদেশ এবং সেন্টার ফর ম্যান অ্যান্ড ম্যাসকুলিনিটি স্টাডিজের (সিএমএসএস) যৌথ উদ্যোগে ‘ব্রেভম্যান ক্যাম্পেইন’-এর অংশ হিসেবে স্কুল পর্যায়ে শিশু-কিশোরদের পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্তি এবং এ থেকে উত্তরণের উপায় বের করতে একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। এ গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের স্কুলগামী কিশোরদের ৬১ দশমিক ৬৫ শতাংশ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, পর্ন ভিডিওতে আসক্ত রাজধানীর ৭৭ শতাংশ কিশোর।

পর্নোগ্রাফি শিশু-কিশোরদের সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি করে, তা হলো যৌনতার ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিকৃত করে দেয়। যৌনতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় পর্ন ভিডিওর বিকৃত যৌনতাকেই তারা যৌনতার আদর্শ মাপকাঠি ভেবে নেয়। যার ফলে তারা এটা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় যে নারী কেবল একটা যৌনবস্তু। আর তাই পর্ন-অভিনেত্রী আর সিনেমার নায়িকারা তো আছেই, তারা তাদের ছোট্ট মস্তিষ্কের সমস্ত শক্তি দিয়ে আশপাশের সব নারীকে নিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভোগা শুরু করে। বিষয়টি অনেকের ক্ষেত্রে এমন এক পর্যায়ে চলে যায়, হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যৌন নিপীড়নের পথকে বেছে নেয়। তখন কেউ না চাইলেও একজন ধর্ষকে পরিণত হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে তারা আশপাশে থাকা অল্প বয়সী কোনো শিশুকে ধর্ষণ করতেও দ্বিধা করে না।

যুক্তরাজ্যের বিচারবিভাগীয় মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১৫ সালে ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে ১২০টি শিশু। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ান সাইকোলজিকাল সোসাইটির ধারণা অনুযায়ী, ২০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের ধর্ষণের জন্য দায়ী কিশোরেরা এবং শিশুদের ওপর চালানো যৌন নিপীড়নের ৩০ থেকে ৫০ শতাংশের জন্য দায়ী এই কিশোরেরা। ইংল্যান্ডে পর্ন দেখে ১২ বছরের বালক কর্তৃক তার ৭ বছরের বোন ধর্ষণের শিকার হওয়ারও প্রমাণ পাওয়া যায়।

  • পর্নোগ্রাফি দেখে ধর্ষকে রূপান্তরিত হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের বাংলাদেশের শিশু-কিশোরেরাও পিছিয়ে নেই। নিচে কয়েক বছরে ঘটা কিছু ঘটনা উল্লেখ্য করা হলো।

  • ঢাকার কেরানীগঞ্জের সিরাজনগর এলাকায় সাত বছরের শিশুকন্যাকে তার নিকটাত্মীয় নবম শ্রেণির এক কিশোর মোবাইলে পর্ন দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের পর ফিল্মি কায়দায় হত্যা করে।

  • পাবনার চাটমোহরে পাঁচ বছর বয়সী শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে ১৩ বছর বয়সী ভ্যানচালক কিশোর আটক।

  • বগুড়ার ধুনটে তিন কিশোর কর্তৃক প্রথম শ্রেণির এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা।

  • মেহেরপুরের মুজিবনগরে ৩ বছর ৫ মাস বয়সী শিশুকে মোবাইলে গেম খেলার কথা বলে নিজেদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে ১৪ বছরের কিশোর।

এমন অসংখ্য ঘটনা প্রতিদিন পত্রিকার হেডলাইন হচ্ছে। আবার অনেক ঘটনা থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে। আর এসব ঘটনা ও শিশু-কিশোরদের ধর্ষকে রূপান্তর করার পেছনে অন্যতম কারণ হলো পর্নোগ্রাফি।

পর্নোগ্রাফি শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশেও বাধাগ্রস্ত করে। যে বয়স দুরন্তপনার, মাঠঘাট দাপিয়ে বেড়ানোর, খেলাধুলায় সময় কাটানোর, সে সময়ে অন্ধকার ঘরে বসে পর্ন দেখার কারণে কিশোরদের মনে বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে অযথা ভয় ঢুকে যায়। সে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগে। বয়ঃসন্ধিকালে এমনিতেই লোকজন থেকে একটু দূরে দূরে থাকার প্রবণতা কাজ করে। পর্নে আসক্তি সেটা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। কিশোরেরা হয়ে পড়ে অসামাজিক। মানুষের সামনে যেতে লজ্জা পায়, পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। চরম একাকিত্ব ও হতাশায় ভোগা শুরু হয়। এই হতাশা, অস্থিরতা ও একাকিত্ব থেকে কখনো কখনো তাদের শুরু হয় মাদকের নেশা।

পর্নোগ্রাফি শিশু-কিশোরদের অগ্রগতি ও বিকাশকে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত করে। তাদের নৈতিক মূল্যবোধ ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে নষ্ট করে দেয়। তারা হয়ে পড়ে আত্মসম্মান ও আত্মবিশ্বাসহীন। তাই প্রত্যেক মা-বাবার উচিত তাঁদের সন্তান সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন থাকা। তাঁদের সন্তানের বাল্য ও কৈশোরকালের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া। তাদের নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার নিশ্চিত করা। সন্তানের মুঠোফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারে তদারক করা। সন্তান কাদের সঙ্গে মেলামেশা করে, তা যথাযথ ওয়াকিবহাল থাকা। সন্তান কোনোভাবে আসক্ত হয়ে পড়লে তার সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণের মাধ্যমে আসক্তি থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করা।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ সরকারের উচিত পর্নোগ্রাফির সরবরাহ ও বিক্রির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া ও ‘পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২’-এর যথাযথ প্রয়োগ করা। এ ছাড়া শিশু-কিশোর বা যেকোনো বয়সের কেউ যাতে ইন্টারনেট ব্রাউজ করে পর্ন ওয়েবসাইটে অবাধ বিচরণ করতে না পারে, সে জন্য সব পর্ন ওয়েবসাইটকে ব্লক করে দেওয়া। না হলে খুব শিগগির আমাদের তরুণ সমাজ নীতি ও নৈতিকভাবে ধ্বংস হয়ে পড়বে এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ চরম বাধাগ্রস্ত হবে।

মো. আবদুর রহিম
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: [email protected]