বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকটা কৃষির ওপর নির্ভরশীল এবং আমাদের সমাজের কাঠামো গড়ে উঠেছে কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ভিত্তিতে। কৃষকেরা শুধু খাদ্য উৎপাদন করেন না, বরং তাঁরা আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সমাজের ভিত্তি রচনা করেন। তবে অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, কৃষকদের অবদান যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয়নি।
বইয়ের পাতায় তাঁদের গুরুত্বের কথা বলা হলেও বাস্তবে তাঁরা সেই সম্মান ও মর্যাদা পান না, যা তাঁদের প্রাপ্য। কৃষকদের প্রাপ্য মর্যাদা না দেওয়া একটি বড় সামাজিক সমস্যা, যা দেশের সার্বিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে।
কৃষিনির্ভর দেশের উন্নয়ন নির্ভর করে সেই দেশের কৃষির ওপর, আর কৃষি নির্ভর করে কৃষকদের শ্রম ও মেধার ওপর। তাঁরা প্রতিদিন মাঠে কাজ করে খাদ্য উৎপাদন করেন, যা আমাদের বেঁচে থাকার মূল উপাদান। ধান, গম, সবজি, ফল, দুধ—এ সবকিছুই কৃষকের পরিশ্রমের ফসল। কিন্তু কৃষকেরা তাঁদের এই পরিশ্রমের যথাযথ মূল্য পান না। অর্থনৈতিক বৈষম্য, বাজারের অস্থিতিশীলতা এবং সরকারি সহযোগিতার অভাবে কৃষকেরা প্রায়ই দুঃখদুর্দশায় দিন কাটান।
রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে কৃষকদের প্রাপ্য সম্মান এবং মর্যাদা প্রায়ই উপেক্ষিত হয়। রাজনৈতিক নেতারা বা সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা কৃষকদের প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন করেন, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়। কৃষকেরা মাঠে কাজ করে যেসব পণ্য উৎপাদন করেন, সেই পণ্যগুলো তাঁদের কাছে যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয় না। বাজারে পণ্যের দামের অস্থিতিশীলতা, মুনাফাখোর মধ্যস্বত্বভোগীদের অবৈধ মুনাফা এবং সঠিক সরকারি নীতিমালার অভাবে কৃষকদের জীবনযাত্রা দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে।
কৃষকদের সহায়তা করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। উন্নত মানের বীজ, সার এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করতে না পারার কারণে উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং বাজারের সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় তাঁদের পণ্য ন্যায্য দামে বিক্রি হয় না। ফলে অনেক কৃষক অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে তাঁদের পেশা থেকে সরে আসতে বাধ্য হন, যা কৃষিক্ষেত্রে একটি বিরাট আঘাত।
তবে শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, আমাদের প্রত্যেকেরই কৃষকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। আমাদের সমাজে কৃষকদের প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়ার জন্য সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে।
কৃষকদের শুধু শ্রমিক হিসেবে নয়, বরং আমাদের জীবনের প্রতিটি দিককে সরবরাহ করা ব্যক্তিদের হিসেবে গণ্য করতে হবে। তাঁদের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে, তাঁদের শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা এবং উন্নত জীবনযাত্রার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যদি আমরা এই পদক্ষেপ নিতে পারি, তাহলে কৃষকেরা তাঁদের কাজে আরও দক্ষ হয়ে উঠবেন এবং দেশের কৃষি খাত আরও উন্নত হবে।
এ ছাড়া কৃষিক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে, যাতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। উন্নত সেচব্যবস্থা, ফসলের সুরক্ষা এবং গবেষণার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবন এনে কৃষকদের সহায়তা করতে হবে। পাশাপাশি, বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের অবৈধ মুনাফা কমিয়ে সরাসরি কৃষকদের সঙ্গে ভোক্তাদের সংযোগ স্থাপন করা উচিত, যাতে কৃষকেরা তাঁদের ন্যায্য মূল্য পান।
কৃষকদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং তাঁদের সঙ্গে ন্যায্য আচরণ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। যদি কৃষকদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয় এবং আমরা তাঁদের যথাযথ মর্যাদা দিই, তাহলে দেশের অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে। কৃষক আমাদের দেশের প্রাণ, তাঁদের সম্মানিত করা ও তাঁদের সমস্যাগুলো সমাধান করা ছাড়া আমাদের উন্নয়ন এবং অগ্রগতি সম্ভব নয়।
মো. আবু রায়হান
শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ