সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে চীনের এক সাবেক সরকারি কর্মকর্তাকে ঘুষ গ্রহণের দায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার খবরটি বাংলাদেশের সচেতন মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
এই ঘটনাটি আমাদের দেশের বিদ্যমান দুর্নীতি পরিস্থিতি এবং এর বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপের কার্যকারিতা নিয়ে একটি গভীর প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দেয়।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার এমন দৃষ্টান্ত যখন বিশ্বমঞ্চে দেখা যায়, তখন আমাদের নিজেদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দিকে তাকালে হতাশাজনক একটি চিত্রই ফুটে ওঠে।
বাংলাদেশ আজ যখন ডলার–সংকট, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের মতো বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে, তখন এই সংকটগুলোর গভীর মূলে প্রায়শই দুর্নীতি নামক একটি অদৃশ্য শক্তিকে খুঁজে পাওয়া যায়। ঘুষ ও অনিয়ম আমাদের সমাজে শুধু নৈতিক স্খলন নয়, এটি একটি ভয়াবহ অর্থনৈতিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।
সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, প্রকল্প বাস্তবায়নে অস্বচ্ছতা ও রাজস্ব ফাঁকির কারণে দেশের কোষাগার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দুর্নীতিবাজদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ। গ্যাস, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য—সর্বত্রই যেন একধরনের ‘অতিরিক্ত সুবিধা’ বা ঘুষ দেওয়া-নেওয়াকে অলিখিত নিয়ম বানিয়ে ফেলা হয়েছে। সমাজের একটি অংশ এই দুর্নীতিকে এমনভাবে স্বাভাবিক করে তুলেছে যে ঘুষ নেওয়াকে অনেকে তাঁদের বেতনের অংশ বা এক প্রকার ‘সরকারি সুবিধা’ হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। এর ফলস্বরূপ, যাঁরা সৎভাবে চলতে চান, তাঁরা বরং কোণঠাসা হয়ে পড়েন।
সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিরা প্রায়শই বিপুল অর্থের মালিক হয়ে একধরনের ‘ভিআইপি’ মর্যাদা লাভ করেন। এটি সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর হতাশা ও ক্ষোভ সৃষ্টি করে। যখন দেখা যায়, ঘুষের টাকায় গড়া সম্পদের পাহাড়ের মালিকেরা সমাজের চোখে সম্মানিত হচ্ছেন, তখন দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে ভুল বার্তা যায়। নৈতিকতা ও সততার মূল্যবোধ ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং একসময় পুরো সমাজই দুর্নীতির এই চক্রে আবর্তিত হতে থাকে। এটি কেবল আর্থিক ক্ষতি নয়, একটি জাতির নৈতিক মেরুদণ্ডকেও ভেঙে দেয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশে, অর্থনৈতিক বৈষম্য, মাদকদ্রব্য পাচার, চাঁদাবাজি ও বেকারত্বের মতো সমস্যাগুলো প্রায়শই দুর্নীতির হাত ধরেই ফুলেফেঁপে ওঠে।
কেবল স্লোগান বা কাগজে-কলমে ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্ন দেখে আমরা জাতির আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারব না। প্রয়োজন চীন সরকারের মতো, বা সিঙ্গাপুরের মতো, যেখানে দুর্নীতি দমনে কঠোর আইনি কাঠামো এবং সেগুলোর নির্মোহ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে।
প্রথমত, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-কে আরও স্বাধীন, শক্তিশালী ও যেকোনো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। ছোট বা বড়, যে–ই হোক না কেন, দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে দ্রুত রায় কার্যকর করার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তা সমাজে একটি শক্তিশালী বার্তা পৌঁছে দিতে পারে। তৃতীয়ত, সরকারি সেবা খাতগুলোতে ডিজিটালাইজেশন স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঘুষ লেনদেনের সুযোগ কমাতে হবে। চতুর্থত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব স্তরে সততা ও নৈতিকতার ওপর জোর দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতের প্রজন্ম দুর্নীতিকে ঘৃণা করতে শেখে।
দুর্নীতি একটি ক্যানসার, যা এ দেশকে ধীরে ধীরে ভেতর থেকে ক্ষয় করে দিচ্ছে। এই ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে হলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ করতে হবে—একটি সত্যিকারের, আপসহীন যুদ্ধ। যদি আমরা এই ‘ঘুষ-মহোৎসবের’ মঞ্চ থেকে দেশকে নামিয়ে আনতে না পারি, তবে অর্থনৈতিক মুক্তি এবং জনগণের প্রকৃত মুক্তি—দুটোই কেবল অলীক স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, কেবল কঠোর পদক্ষেপই পারে এই বাংলাদেশকে প্রকৃত অর্থে একটি ‘সোনার বাংলা’য় পরিণত করতে, যেখানে সততা হবে সমাজের সর্বোচ্চ সম্মান।
শহিদুজ্জামান শাকিল শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ