বই পাঠাভ্যাসে আমাদের যত অনাগ্রহের কারণ

জ্ঞানের পরিসর বাড়াতে বই পড়ার গুরুত্ব আমরা সবাই জানি। কিন্তু দৈনন্দিন জীবন জীবিকায় বই পড়াকে কতটা পাঠ্য অভ্যাসে পরিণত করতে পেরেছি সেটা প্রশ্ন হিসেবে থেকে যাচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রগতিশীলতার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের সৃজনশীলতার বহুমাত্রিক বিকাশ। জীবনে সফলতার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেলে পড়তে হবে বই, গড়ে তুলতে হবে বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব।

প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় হাতে হাতে সবার স্মার্টফোন, ট্যাব ইত্যাদি আসায় মানুষ নিজস্ব সত্তা থেকে বেরিয়ে আসছে। অবসর সময়গুলো কাটছে ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। ফলে পাঠ্যবিমুখতা সৃষ্টি হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। লাইব্রেরিগুলো জনমানবহীন হয়ে পড়েছে। থেমে গেছে পছন্দের বই খোঁজার হিড়িক।

মানবজীবনে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা যেন শুধুমাত্রই একটি সরকারি চাকরিপ্রাপ্তি। যে কারণে কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি লাভের আশায় পড়াশোনা করা ছেলে-মেয়েদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

শৈশব থেকেই শিক্ষার মানে একটা ভুল বার্তা দিয়ে স্কুলে পাঠানো হয়েছে আমাদের। যেমনটি বলা হতো, ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে সে’। তাই জিপিএ-ফাইভ পাওয়ার জন্য সবাই পড়াশোনা করছে; কোচিং, স্কুলে ছুটছে। শিশুরা পড়া তৈরি করছে অবসাদ, বিরক্তি, জোর-জবরদস্তি সহকারে। যা নিয়ে বই পড়া প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘সেখানে ছেলেদের বিদ্যে গেলানো হয়, তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর নাই পারুক। এর ফলে ছেলেরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণ শীর্ণ হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে।’

পড়ার মধ্যে যে আনন্দ রয়েছে, সেই আনন্দকে আমরা ভয় ও বিতৃষ্ণায় পরিণত করে ফেলেছি। ফলস্বরূপ একবার যে ছেলেটি বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোয়, পড়ার সঙ্গে তার সব সম্পর্ক তখনই চুকে যায়।এ জন্যই বোধ করি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘বাল্যকাল হইতে আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই। কেবল যাহা কিছু নিতান্ত আবশ্যক তাহাই কণ্ঠস্থ করিতেছি। তেমন করিয়া কোনো মতে কাজ চলে মাত্র, কিন্তু মনের বিকাশ লাভ হয় না।’ শিক্ষকেরাও সিলেবাসের নির্দিষ্ট গুটি কতেক বিষয়ের বাইরেও যে জ্ঞানের বিশাল জগৎ রয়েছে, তার সন্ধান দিতে পারেন না বা দেন না।

মানবজীবনে বইয়ের গুরুত্বের কথা স্মরণ করে লিও টলস্টয় বলেছেন, ‘জীবনে মাত্র তিনটি জিনিসের প্রয়োজন বই, বই এবং বই।’

বই নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করা, পছন্দের তালিকার বেশ কিছু বই থেকে একটি বই বেছে নেওয়া, এতেও মানুষের মেধার বিকাশ ঘটে। কিন্তু বর্তমানে অনেকেই এই সময় খরচ করতে চান না। তাছাড়া অনেকেই চাহিদা অনুযায়ী তার কাঙ্ক্ষিত বিষয়টিকে সাজানো গোছানো পেতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ফলে বইয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জ্ঞান আহরণ প্রতি বেশ অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু যিনি বই পড়াকে বন্ধু হিসেবে নিতে পেরেছেন তিনি বই পড়ার আনন্দ পেয়েছেন।

অনেক পাঠক বই পড়তে গিয়ে নিজের দিকেও ঠিকমতো মনোযোগ দেওয়ার সময় পান না। বহু ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ একবার স্কুলে পড়ার সময় লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ায় এমন মনোযোগী ছিলেন, কখন যে দপ্তরি দরজা বন্ধ করে চলে গেছে সেটা টেরও পাননি। পরে দপ্তরিকে ডেকে বিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে বের হন।

আমাদের পরিবারগুলোতেও নেই নিয়মিত পড়ার চর্চা। বেশ কিছু অভিভাবকেরা যারা পড়ালেখার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন, তারাও শিক্ষায়তনিক পড়া বা সিলেবাসের বাইরের পড়াকে অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর মনে করেন। তারাও একপর্যায়ে পছন্দের বই পড়াতে নিরুৎসাহিত করে থাকেন।

মানবিক বিকাশ, নীতি-নৈতিকতার ভূমিকা, বিবেক-বিবেচনা পরিধিগুলো কেবলমাত্র বই আমাদের শেখাতে পারে। সে জন্য নিয়মিত পাঠ্যাভাসে লাইব্রেরিতে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। সময় উপযোগী কিংবা পছন্দের তালিকায় রাখা বই ক্রয় করা যাচ্ছে অনলাইনের মাধ্যমেও। অর্থাৎ তথ্য প্রযুক্তির যুগে যান্ত্রিক কাঠামোর গতিশীলতায় লাইব্রেরিকেন্দ্রিক পাঠাভ্যাস গড়ে উঠছে না। থাকছে না লাইব্রেরিতেও পড়ার পরিবেশ ও সঠিক ব্যবস্থাপনা। ফলে লাইব্রেরিবিমুখ হওয়ার সংখ্যাও বাড়ছে গণহারে।

জাতি বিনির্মাণে বই পড়া এবং বইয়ের আলোকে নিজেকে গড়া প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব এবং কর্তব্য। এ জন্য শুধু পাঠক বা সামাজিক পরিবর্তনই প্রয়োজনীয় নয়। প্রয়োজন পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, সমাজ, রাষ্ট্র সবার সম্মিলিতভাবে দায়িত্ব পালন। শুধুমাত্র লাইব্রেরিই পাঠাভ্যাস তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারবে না।

সুমাইয়া আকতার
সরকারি ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল