ঢাকা বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে, করণীয় কী

পরিকল্পিত শহর হিসেবে গড়ে তোলা হোক ঢাকাকে

ঢাকার পানি, বাতাস ও শব্দদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। পরিবেশের অস্বাভাবিক দূষণে বাড়ছে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ। বর্তমানে ঢাকা দূষণের নগরীতে পরিণত হয়েছে এবং হারাচ্ছে বাসযোগ্যতা। শহরের রাস্তা দিয়ে চলাচল করার সময় উপরে ভবন নির্মাণে কাজ, নিচে বিদ্যুতের তার থেকে শুরু বিভিন্ন লাইনের তার। রাস্তার দুই পাশে রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন অপরিকল্পিত অবকাঠামো, গ্যাস লাইন। ফলে ঢাকা হয়ে উঠছে বসবাসের এক অযোগ্য শহর।

বিশ্বের ‘বসবাসের অযোগ্য’ শহরগুলোর অন্যতম হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে ঢাকা। সম্প্রতি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের শহর সমীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। এই তালিকায় ৪৩.৮ স্কোর নিয়ে ঢাকার অবস্থান ১৬৬তম স্থানে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা বিশ্বের ‘বসবাসের অযোগ্য’ শহরগুলোর অন্যতম হওয়ার পেছনে দায়ী সেখানকার অবকাঠামো।

বর্তমান সময়ে ঢাকার তাপমাত্রা অসহনীয় সেই সঙ্গে বাতাসে দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। যেভাবে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনায় পরিণত হচ্ছে এই শহর তাতে এখানে টিকে থাকাটাই অস্বাভাবিক। বছর বছর তথাকথিত কোটি টাকার বাজেট পাশ হলেও কোনো খোঁজখবর নেই সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে। সাধারণ মানুষ নিরাপদ নেই তাদের নিজেদের বাসস্থানেও। রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকায় নির্মাণাধীন বহুতল ‘সৈনিক ভবনের’ দেয়াল ধসে আহত হন শিশু সুরাইয়া। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।

গত সোমবার সকাল সাড়ে ৬ টার দিকে দক্ষিণখান কাজীবাড়ি রোডের ২৫১ গাওয়াইর নির্মাণাধীন ১৪ তলা ভবনের ১১ তলার দেয়ালের একটি অংশ ধসে ঘরের চালের ওপরে পড়ে। এতেই গুরুতর আহত হন বাবা ও মেয়ে। তবে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই নিরাপত্তার বিষয়টি বলা হচ্ছিল। কিন্তু ভবন কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করেনি। তারা নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিলে আজকে এত বড় দুর্ঘটনা হতো না। কিন্তু এই দায়ভার কাদের?

ঢাকা শহরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ওপর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, নগরীতে গড়ে ওঠা অবকাঠামোর ৭৩ শতাংশই পুরোপুরি অপরিকল্পিত। যার কারণে প্রতিবছর অগ্নিকাণ্ড, ভবন ধসে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়।

সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাইকার করা এক যৌথ জরিপে জানা যায়, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে এবং ১ লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তৈরি হবে সাত কোটি টন কংক্রিটের স্তূপ। রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও শুধু ভবন ধস নয়, ঢাকার অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও গ্যাসলাইন এ নগরকে একটি অগ্নিকূপে পরিণত করতে পারে। কয়েক হাজার ভবন ধসে পড়বে। কারণ, আমাদের ভবনগুলো এখনও নিরাপদভাবে তৈরি হচ্ছে না।

ঢাকার পরিবেশের মারাত্মক সমস্যাগুলোর অন্যতম বায়ুদূষণ। শহরে বায়ুদূষণের প্রধান দুটি উপাদান হল শিল্পকারখানা ও যানবাহন। অপরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানা স্থাপনে ফলে ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ ক্রমাগত বাড়ছে।

বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেন, পৃথিবীর বড় শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার বাতাসে সবচেয়ে বেশি মিশছে সিসা। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় যানবাহনগুলো প্রতিদিন ১০০ কেজি সিসা ১ দশমিক ৫ টন সালফার-ডাইঅক্সাইড, ৬০ টন কার্বন মনোঅক্সাইড নির্গত করে। এসব উপাদান ক্রমাগত বাতাসের সঙ্গে মিশছে। সেই বাতাস আমাদের নিশ্বাসের সঙ্গে মিশে দেহের ভেতরে প্রবেশ করে যক্ষ্মা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, হাঁপানি প্রভৃতি মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করে।

ঢাকা শহরের আরেকটি বড় সমস্যা হলো তীব্র যানজট। এই যানজট রাজধানী শহরের অতি পরিচিত দৃশ্য যা নাগরিক জীবনের জন্য এক ভোগান্তি। গবেষণায় দেখা গেছে, যানজটের কারণে রাজধানীতে পরিবহন প্রবেশ করতে না পারায় প্রতিদিন বিভিন্ন খাত থেকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা আয় নষ্ট হচ্ছে। সব মিলিয়ে যানজটের কারণে দিনে আর্থিক ক্ষতি প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা এই ১২ ঘণ্টায় রাজধানীতে চলাচলকারী যানবাহনকে যানজটের কারণে প্রায় সাড়ে ৭ ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়। ঢাকায় এখন সুশাসন, সবুজায়ন বৃদ্ধি এবং প্রকৃতিভিত্তিক পরিকল্পনার কথা ভাবা উচিত।

পরিকল্পিত নগর বলতে একটি পরিকল্পিত জনবসতি, যার সবকিছু হবে পরিকল্পনা অনুযায়ী। সুপরিকল্পনা ছাড়া কোনো শহরকে সুন্দর শহরে পরিণত করা যায় না। ঢাকা শহরকে সুন্দর শহরে পরিণত করার জন্য সবুজের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য প্রচুর বৃক্ষরোপণ করতে হবে। প্রতিটি এলাকায় থাকতে হবে খেলার মাঠ, থাকতে হবে জলাশয়, থাকতে হবে পার্ক। এ জন্যও দরকার সঠিক পরিকল্পনা। ঢাকা শহরকে সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে হবে।

ঢাকাকে বাসযোগ্য করার জন্য শহরের নবনির্মিত প্রতিটি ভবন রাজউকের বিধিমালা মেনে তৈরি করতে হবে। যদি অবৈধভাবে ভবন নির্মাণ করতে চায় তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। সেই সঙ্গে শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ কমাতে হবে।

ঢাকার যানজটের সমস্যা নিরসন করতে হবে। যানজট সমস্যা নিরসনে কয়েকটি প্রস্তাব দেওয়া যেতে পারে, যা বাস্তবায়ন হলে যানজটের সমস্যা থেকে নগরবাসী মুক্তি পেতে পারে। প্রস্তাবগুলো হলো—রাজধানী ঢাকায় ব্যক্তিগত মোটরগাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যাধিক্য যানজটের একটি অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচ্য হয়। চৌরাস্তাগুলোতে টানেল নির্মাণ ছোট ছোট বিকল্প রাস্তা তৈরি করা, ট্রাফিক পুলিশের জনবল বৃদ্ধি করা, ঢাকা থেকে বের হওয়া এবং প্রবেশের রাস্তাগুলো প্রশস্ত করা। যত্রতত্র গাড়ি পার্ক করা ও গাড়ি ঘোরানো থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করা দরকার। ট্রাফিক পুলিশকে আধুনিক সরঞ্জাম ও বিদেশি বিশেষজ্ঞ দ্বারা প্রশিক্ষণ দেওয়া। অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে ফুটপাত ও অন্যান্য রাস্তা দখলমুক্ত করতে হবে।

এই শহরে প্রতিটা মুহূর্তে বেঁচে থাকাটাই অস্বাভাবিক। এখনই সময় সচেতন হওয়ার। চাই পরিকল্পিত ভবন, চাই পরিকল্পিত শহর। দূর হোক অবৈধ কলকারখানা, মার্কেট। সরকার কঠোর হস্তে দমন করবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। তাই কর্তৃপক্ষ সুদৃষ্টি সেই সঙ্গে জনসাধারণের সচেতনতা কাম্য।  

সাকিবুল হাছান
ঢাকা কলেজ