আমাদের দেহের সুস্থতার সঙ্গে খাদ্য ও পুষ্টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। খাদ্য আমাদের শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে প্রধান ভূমিকা পালন করে। পুষ্টিবিজ্ঞানে বলা হয়ে থাকে, আমরা যা খাই, আমরা তাই হয়ে উঠি। পৃথিবীব্যাপী অসংক্রামক রোগের যে ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে এবং বিশ্বের মোট মৃত্যুর ৭৪ শতাংশের জন্য দায়ী অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে আমাদের সর্বোচ্চ সচেতন হতে হবে। খাদ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও স্বাস্থ্যকর অভ্যাস এই নীরব ঘাতককে প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।
আমরা যে খাবার খাই, তা পুষ্টিগুণের ওপর ভিত্তি করে মুখ্য পুষ্টি উপাদান ও গৌণ পুষ্টি উপাদান—এই দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। মুখ্য পুষ্টি উপাদান হলো শর্করা, আমিষ ও ফ্যাট বা স্নেহ পদার্থ, যা আমাদের দেহে শক্তি উৎপাদন, ক্ষয়পূরণ ও বৃদ্ধি সাধনের জন্য অধিক পরিমাণে প্রয়োজন হয়। অপর দিকে গৌণ পুষ্টি উপাদান হলো ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ, যা আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি ও সুস্থ বিকাশের জন্য অল্প কিন্তু পরিমাণমতো গ্রহণ করা আবশ্যক।
খাদ্যে থাকা শক্তিকে সাধারণত ক্যালরিতে পরিমাপ করা হয়। একজন সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের জন্য প্রতিদিন ২৫০০ ক্যালরি এবং নারীদের ক্ষেত্রে ২০০০ ক্যালরি শক্তির প্রয়োজন। প্রতি গ্রাম শর্করা ও আমিষ থেকে আমাদের দেহ ৪ ক্যালরি এবং ফ্যাট বা স্নেহ পদার্থ থেকে ৯ ক্যালরি শক্তি পেয়ে থাকে। আমাদের মোট ক্যালরির ৫০-৬০ শতাংশ শর্করা, ২০-২৫ শতাংশ আমিষ এবং ২৫-৩০ শতাংশ ফ্যাট বা স্নেহজাতীয় খাবার থেকে গ্রহণ করা উচিত।
ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ থেকে আমাদের দেহ কোনো শক্তি পায় না। কিন্তু দেহের সব পুষ্টি উপাদান সঠিকভাবে পরিপাক করতে এবং তা থেকে পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ করে দেহের সুস্থতা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ অপরিহার্য। তাই আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য গ্রহণ শুধু ক্যালরির ওপর নির্ভর না করে অত্যাবশ্যক সব পুষ্টি উপাদানসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
আমাদের দৈনিক আমিষজাতীয় খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ আমাদের দেহের ওজনের সমানসংখ্যক গ্রাম। সে ক্ষেত্রে ৬০ কেজি ওজনের একজন মানুষের জন্য ৬০ গ্রাম আমিষ গ্রহণ করতে হবে। আমিষের চাহিদা পূরণে প্রাণিজ আমিষের পাশাপাশি উদ্ভিজ্জ আমিষও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ডাল, বাদাম, পেস্তা, শিমের বিচি, মটরশুঁটি, কুমড়াবীজ, পালংশাক, ফুলকপি, মাশরুম, ছাতু ও কাঁঠাল অন্যতম।
অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবারে খাদ্য উপাদানের রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে বলে তাতে ক্ষতিকর ট্রান্সফ্যাটের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। তা ছাড়া অতিরিক্ত চিনি ও লবণ যোগ করায় তা অংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। অপর দিকে অসম্পৃক্ত উপকারী ফ্যাট দেহে কোলেস্টেরলের মাত্রা স্থিতিশীল রাখা, হৃদ্রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। বিভিন্ন রকমের বাদাম, আখরোট, অ্যাভোকাডো, সামুদ্রিক মাছ, দুগ্ধজাতীয় খাবার, উদ্ভিজ্জ তেল (জলপাই, তিলের তেল, ক্যানোলা, সূর্যমুখী, সয়াবিন, কর্নওয়েল) ইত্যাদি উপকারী ফ্যাট বা স্নেহজাতীয় পদার্থের অন্যতম উৎস।
ভিটামিন সাধারণত দুই ধরনের। একটি হচ্ছে পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন আর অন্যটি হচ্ছে ফ্যাট বা স্নেহ দ্রবণীয় ভিটামিন। পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন হলো ভিটামিন বি এবং ভিটামিন সি। পানিতে দ্রবণীয় হওয়ায় এসব ভিটামিন শরীরে জমা থাকে না। তাই ভিটামিন বি এবং সি প্রতিদিন গ্রহণ করার মাধ্যমে শরীরে এর সরবরাহ ঠিক রাখতে হয়। ভিটামিন বির অন্যতম উৎস হচ্ছে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, কলিজা, ফুলকপি, শিম, বাঁধাকপি, মটরশুঁটি, মুগডাল, ছোলা, লাল চাল ও লাল আটা। অন্যদিকে ভিটামিন সির উৎসগুলো হচ্ছে টকজাতীয় সব ফল, লেবু, আঙুর, পেঁপে, জাম ও কাঁচা মরিচ।
ভিটামিন এ, ডি, ই এবং কে ফ্যাট বা স্নেহ দ্রবণীয় হওয়ায় চাহিদার অতিরিক্ত গ্রহণ করা হলে তা শরীরে জমা থাকে। তা ছাড়া খাবার থেকে আমাদের শরীর পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি সংগ্রহ করতে পারে না। তাই শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি হওয়ার জন্য প্রতিদিন দিনের শুরুতে অন্তত ১৫-৩০ মিনিট সূর্যের আলোয় থাকতে হবে।
ফাইবার বা আঁশসমৃদ্ধ খাবার আমাদের অন্ত্রের স্বাস্থ্যকে উন্নত করে পাশাপাশি কোলন ক্যানসার, হৃদ্রোগ, কোষ্ঠকাঠিন্য, উচ্চ রক্তচাপসহ দেহের রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। ফাইবার বা আঁশসমৃদ্ধ খাবারের প্রধান উৎস হচ্ছে সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, লাল চাল, লাল আটা, বাদাম, ছোলা, ডাল, যব ও ইসবগুল।
খাদ্য ও পুষ্টির এ বিষয়গুলোর কার্যকারিতা স্বাস্থ্যকর অভ্যাসের দ্বারা প্রভাবিত হয়। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট শারীরিক ব্যায়াম কিংবা খেলাধুলা এবং পর্যাপ্ত ঘুম হজমশক্তি এবং বিপাকক্রিয়া উন্নত করে। আমাদের দেহঘড়ির ছন্দ ঠিক রাখতে এবং পাকস্থলীকে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম দিতে সকালের খাবার সকাল ৭-৮টার মধ্যে গ্রহণ করা এবং রাতে ভারী খাবার না রাখা ও ঘুমানোর অন্তত ৩ ঘণ্টা আগে তা সম্পন্ন করতে হবে। তা ছাড়া পর্যাপ্ত পানি পান এবং খাবার খাওয়ার ২০-২৫ মিনিট পর পানি পান করলে খাবার হজমে সুবিধা হয়।
আরাফাত হোসেন
শিক্ষার্থী
পুষ্টি ও খাদ্য প্রকৌশল বিভাগ
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।