বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রস্তুতি কেন এতটা ব্যয়বহুল

প্রতিবছর উচ্চমাধ্যমিকের পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্ন দেখেন দেশের ১৪-১৫ লাখ শিক্ষার্থী। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই তাঁরা স্বপ্নপূরণের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শুরু হয় প্রস্তুতি। বেড়ে যায় পড়ালেখার খরচ। আরম্ভ হয় বিভিন্ন কোচিং সেন্টার আর ভাইয়াদের প্রাইভেট-বাণিজ্য। তীব্র প্রতিযোগিতায় নিজের অবস্থান নিশ্চিত করতে প্রতিবছর সারা দেশ থেকে অসংখ্য শিক্ষার্থী ঢাকায় এসে ভর্তি হন প্রাইভেট ও কোটিং সেন্টারগুলোতে। একজন শিক্ষার্থী ঢাকার বাইরে থেকে রাজধানীতে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে চাইলে শুধু রুমভাড়া বাবদ প্রতি মাসে খরচ করতে হয় প্রায় চার হাজার টাকা। ৫ মাসে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ২০ হাজার টাকা। জনপ্রতি খাওয়া বাবদ প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা হিসাবে ৫ মাসে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৫ হাজার টাকা।

এ তো গেল শুধু থাকা আর খাওয়া। এবার আসি মূল হিসেবে। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রস্তুতির জন্য কোচিং সেন্টারে ফি দিতে হয় প্রায় ২২ হাজার টাকা। মেডিকেলসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইউনিট ভেদে এই পরিমাণ আবার ভিন্ন হয়। কোচিং সেন্টার থেকে বই সরবরাহ করলেও প্রায় শিক্ষার্থীই নিজের সেরা প্রস্তুতির জন্য অতিরিক্ত কিছু বই কিনে থাকেন। আর প্রতিদিন বিভিন্ন শিট ফটোকপি তো আছেই।

এবার নজর দিই এত সব আয়োজন যেই প্রস্তুতি নিয়ে, তার কতটা বাস্তবায়িত হচ্ছে ক্লাসে? কোচিং সেন্টারগুলোতে প্রতি ক্লাসে ২০০ থেকে ২৫০ জন শিক্ষার্থী থাকায় সেখানকার ভাইয়াদের মানে শিক্ষকদের সদিচ্ছা থাকার পরও সব টপিক বোঝানো সম্ভব হয় না। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেক শিক্ষক আবার ইচ্ছা করেই সব বিষয় পড়ান না। কিছুটা বাকি রাখেন। তখন শিক্ষার্থীদের সেই সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট ব্যাচে পড়তে হয়। সেখানে আবার ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ৫-৭ জনের ব্যাচে ২৪ হাজার টাকায় কোর্স করানো হয়। টাকার অঙ্কটা জনপ্রতি দাঁড়ায় প্রায় ৩ হাজার ৫০০-৪ হাজার ৮০০ টাকা।

মেডিকেল আর বাণিজ্য ইউনিটে প্রস্তুতির জন্য হিসাবটা আরও মজার। সেখানে শিক্ষকেরা ১০০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে একেকটি ব্যাচ বানান, যার জন্য দিতে হয় প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে। শিক্ষার্থীর হিসাবে নতুন করে যুক্ত হয় ৫ মাসে ৫ হাজার টাকা। আর সেই শিক্ষক বা ভাইয়া যদি একটি প্রাইভেট ব্যাচও পড়ান, তবে প্রতি মাসে ১ লাখ টাকা করে ৫ মাসে ৫ লাখ টাকা আয় করেন। ব্যাচের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে আয়ের পরিমাণও।  

আমরা যদি একজন শিক্ষার্থীর ঢাকায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রস্তুতির জন্য ন্যূনতম খরচ বিবেচনা করি, তাহলে ওপরের তথ্য অনুযায়ী তা হবে প্রায় ৭১ হাজার টাকা। গাড়িভাড়া, শিট ফটোকপি, পকেট খরচ তো আছেই। এরপর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার আবেদন ফরম পূরণ বাবদ আছে বিপুল অর্থ। কোচিং সেন্টারে না পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রস্তুতি চিন্তাই করা যায় না, এমন পরিস্থিতিতে যেন খরচের দিকে নজর দেওয়ার কেউ নেই।

এমন অনেক উদাহরণ আছে, যাঁরা একবুক স্বপ্ন নিয়ে ভালো প্রস্তুতির আশায় রাজধানীতে গিয়ে কোচিং সেন্টারে ভর্তি হন এবং কিছুদিন পর আর্থিক অসচ্ছলতায় ফিরে আসতে হয় নিজ জেলায়। তাঁদের মধ্যে কারও কারও কঠোর পরিশ্রমের ফলে স্বপ্নপূরণ হলেও যাঁরা সেই স্বাদ পান না, তাঁদের অন্তরে আর্থিক অসচ্ছলতার ব্যাপারটি দারুণভাবে পীড়া দেয়।

মন্দার পৃথিবীতে টাকার অভাবে কারও লেখাপড়া আটকে থাকে না, এটি সত্য; কিন্তু টাকা অনেকের স্বপ্নপূরণের পথে বাধা হিসেবেও আবির্ভূত হয়। এক ঘণ্টায় নিজের মেধার কতটুকু প্রমাণ দেওয়া সম্ভব, তা নিয়ে অনেক কথা বলা গেলেও এই এক ঘণ্টার পরীক্ষার জন্য লাখ লাখ স্বপ্নবাজ শিক্ষার্থীর পেছনে পরিবারকে যে অর্থ খরচ করতে হয়, তা কমানো এখন সময়ের দাবি। কোচিং সেন্টারগুলোর কোটি টাকার বাণিজ্যে কোনো শিক্ষার্থীর স্বপ্ন যেন মুখথুবড়ে না পড়ে, সেটি দেখার দায়িত্ব আমাদের সবার।

মেহেদী হাসান নাঈম
শিক্ষার্থী
সরকারি আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া
[email protected]