আদৌ কি শিক্ষাব্যবস্থায় মুখস্থবিদ্যা পরিহার করা সম্ভব?

এই উপমহাদেশে সুদীর্ঘ ব্রিটিশ শাসনামল আমাদের আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় যেমন অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল, এই দেশের কুটির শিল্পকে ধ্বংস করে দিয়েছিল, এই উপমহাদেশকে করেছিল তাদের উৎপাদিত পণ্যের কাঁচামাল সংগ্রহের কারখানা, তেমনি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়ও ব্রিটিশ শাসনামল বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। ব্রিটিশরা এ দেশে শিক্ষিত, মননশীল ও সৃজনশীল জাতি গঠনের দিকে মনোযোগ না দিয়ে স্রেফ তাদের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য একদল সুবিধাভোগী এবং সিভিল সার্ভিস গঠনে মনোযোগী ছিলেন।

বর্তমানে আমাদের দেশের হাতে গোনা কিছু শিক্ষার্থী বাদে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর লক্ষ্য থাকে, পড়ালেখা করে চাকরি গ্রহণের মাধ্যমে আর্থসামাজিক মুক্তি লাভ করা। এ দেশে প্রতিবছর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি পরীক্ষা নামের কুরুক্ষেত্রে অনেক ছাত্রছাত্রী অংশগ্রহণ করেন। অথচ কম আসনসংখ্যার কারণে খুব কমসংখ্যক ছাত্রছাত্রী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তির সুযোগ পান।

অনেক বড় প্রতিযোগিতা, অনেক বড় সিলেবাস, স্বল্প সময়ের এই যুদ্ধে টিকে থাকতে হলে কোচিং সেন্টারের শরণাপন্ন হয়ে শর্টকাট পদ্ধতিতে পড়তে হবে আর না হয় মুখস্থ করতে হবে। অন্য ক্ষেত্রে যাঁরা কোচিং সেন্টারের শরণাপন্ন হতে পারেন না বা যাঁরা অনলাইন কোচিং সেন্টার থেকে ভালো প্রতিক্রিয়া পান না, তাঁদের অনেকটা কম সময়ে পুরো সিলেবাস শেষ করতে হয়। যার দরুন শিক্ষার্থীদের অনেক বেশি মুখস্থবিদ্যার দিকে অগ্রসর হতে হয় এবং পারদর্শী হতে হয়। অনেক বেশি মানসিক চাপ সহ্য করে মুখস্থ করতে হয়। তা ছাড়া যেকোনো লিখিত ও অলিখিত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সময়ের স্বল্পতা থাকে। এই স্বল্প সময়ের ভেতর সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দানের জন্য পর্যাপ্ত সময়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বিধি বাম, নিজের শেষ বিন্দু পরিমাণ পরিশ্রম দিয়ে হলেও মুখস্থ করে পরীক্ষায় ১ নম্বর বেশি তুলতে শিক্ষার্থীরা বদ্ধপরিকর।

এ দেশের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রস্তুতির সময় যে পরিমাণ পরিশ্রম করেন, বিশ্বের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি হতেও এত পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় না। তার ওপর আমাদের হয়েছে মরার উপর খাঁড়ার ঘা। দুর্বল অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত ব্যবস্থা এবং দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থার দ্বারস্থে পদানত হয়ে আমাদের শিশু-কিশোরেরা প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ভালো মানের শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠদান পাচ্ছে না। হয়তো কোনো শিক্ষার্থীর পরিবারের আর্থিক সংগতি আছে, কিন্তু দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থার কারণে তারা শিক্ষার সুফল পাচ্ছে না। আবার হয়তো কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ভালো পাঠদান করায়, কিন্তু দুর্বল অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কারণে শিশু-কিশোরদের অনেকে অনুপস্থিত থাকে। তাই অল্প বয়স থেকেই আমাদের অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষার আগের দিন পড়বে বলে ঠিক করে এবং স্বল্প সময়ে সিলেবাস শেষ করার জন্য শর্টকাট উপায়ে মুখস্থ করে এসে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে।

তা ছাড়া সুষ্ঠু পাঠদানে শিক্ষকদের অবহেলা, শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে পড়া না বুঝিয়ে বরং মুখস্থ করে আসতে বলা, নির্দিষ্ট আসনসংখ্যার বিপরীত অতিরিক্ত শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে পাঠদান, বাজারে গাইড, নোট বই ও বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের দৌরাত্ম্য, শিক্ষার্থীদের জিপিএ ৫ পাওয়ার জন্য অভিভাবকদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ইত্যাদির দরুন না বুঝে পড়ার অভ্যাস, মুখস্থবিদ্যার সংস্কৃতি ইত্যাদি আমাদের শিশু-কিশোরদের ভেতর অল্পতেই অঙ্কুরিত হয় এবং একপর্যায়ে এটা প্রকট আকার ধারণ করে। অনেকেই সুবিধাজনক অবস্থান মনে করে নিজেকে এখান থেকে বের করতে পারে না। আবার কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী নিজেকে এই অভিশাপ থেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়। আবার তিক্ত হলেও সত্য যে এই মুখস্থবিদ্যার বলি হয়ে, মাথায় চাপ নিতে না পেরে অনেক ছাত্রছাত্রী শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ঝরে পড়ে।

অন্যদিকে আমাদের দেশের চাকরির বাজারে দিকে যদি লক্ষ করি, প্রতিবছর এ দেশে ২০ লাখের বেশি চাকরিপ্রার্থী চাকরির বাজারের জন্য উপযুক্ত হন। কিন্তু সে তুলনায় চাকরি অনেক কম। অনেককে চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়। দেশের বৃহৎ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার আসর বিসিএসে বছরে সাড়ে তিন লাখ থেকে চার লাখ চাকরিপ্রার্থী অংশগ্রহণ করেন। সেখানেও মুখস্থবিদ্যা ছাড়া উপায় নেই।

এই মুখস্থবিদ্যার সংস্কৃতির পরিণাম ভয়াবহ। মুখস্থবিদ্যার ফলে শিক্ষার্থীরা তাঁদের অর্জিত শিক্ষাকে বাস্তবে রূপদান করতে পারেন না। পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের এই যুগে শিক্ষার্থীদের সুষ্ঠু ও সুনাগরিক হিসেবে এগিয়ে নিতে, বিজ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে, সুষ্ঠু মননশীলতা ও সৃজনশীলতা বিকাশে অতিসত্বর মুখস্থবিদ্যা পরিহার করা এবং এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করা জরুরি।

আশার কথা হলো, বর্তমান সরকার শিক্ষানীতিতে পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে। যার অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে এনে তাদের সৃজনশীলতা বিকাশে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যেহেতু সুদীর্ঘ কাল ধরে শিক্ষাব্যবস্থায় মুখস্থবিদ্যার সংস্কৃতি প্রবহমান, তাই এর প্রভাব থেকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মুক্ত করার বিষয়টাও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও উচিত মুখস্থবিদ্যার নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা; শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করার পরিবর্তে বুঝে বুঝে পড়তে উদ্বুদ্ধ করা; ভালো পাঠদানের জন্য শিক্ষকদের আরও কার্যকর প্রশিক্ষণ দেওয়া; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট শিক্ষার্থীদের বিপরীতে প্রয়োজনীয় আসনসংখ্যা; শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষের ব্যবস্থা করা, বাজারে গাইড ও নোট বই এবং কোচিং বাণিজ্য বন্ধে সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করা।

সর্বোপরি অভিভাবকদের বুঝতে হবে যে মুখস্থবিদ্যা তাঁদের কোমলমতি সন্তানদের ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মুখস্থ করে জিপিএ ৫ অর্জন কখনো মেধার পরিচয় বহন করতে পারে না। কারণ, শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতে বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন, সমস্যা সমাধানের উপযোগী, চিন্তা–চেতনায় সৃজনশীল, সুষ্ঠু ও মননশীলতা এবং সুনাগরিক ও আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাই শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

দেলোয়ার হোসেন
লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
ই–মেইল: [email protected]