সেই চাঁদরাতগুলো, পাড়া বেড়ানো চক্করগুলো

ওই দেখা যায় ঈদের চাঁদ

বাড়ি যেতে পারিনি, তাই মন এখনো বাড়ি বাড়ি-ই করছে। কষ্টটা পবিত্র রমজান মাসের শুরু থেকেই অনুভব হচ্ছিল। কারণ, তখনই আন্দাজ করতে পারছিলাম যে এবারও আমাদের বাড়ি যাওয়া হবে না।

আর দিন শেষে এমনটাই হলো। শৈশবের শত আবেগমিশ্রিত ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’ সুরের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির বাচ্চা-বুড়ো সবার ঈদ-আমেজের শুরুটা কল্পনায় ঘুরপাক খাবে খুব।

ছেলেদের বাজি ফোটানোর আমেজ আর মেয়েদের মেহেদি—এ যেন চাঁদরাতের অন্য রকম এক বৈশিষ্ট্য।

এদিকে যাঁরা ইতেকাফে ছিলেন, তাঁরাও মসজিদ থেকে বাড়ি ফিরবেন। চাঁদরাতে সবাই মিলে পুরো চৌধুরীবাড়ি চক্কর দিত ঈদ মোবারক বলে বলে। তখন এক অসাধারণ অনুভূতি কাজ করত।

চাঁদ দেখামাত্রই ভাই-বোন আর আরও বাচ্চাকাচ্চাসহ আমরা সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য বেরিয়ে পড়তাম। কিছু কিছু ঘরে প্রবেশের আগে কয়েকবার উঁকিঝুঁকি দিয়ে নিশ্চিত হতাম যে অমুক, তমুক আছে কি-না। কেউ কেউ ছিল, যাদের খুব ভয় পেতাম। সামনে যাওয়ার সাহস হতো না একদম। কারণ, বড়দেরও দেখতাম তাদের খুব ভয় পেতেন। একে পুরোপুরি ভয় বলা ঠিক হবে না। সম্ভবত এটা সম্মান দেখানোর ভিন্ন কোনো রূপ।

একদিকে ভয় অন্যদিকে সবার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ইচ্ছা। আমাদের আবেগমিশ্রিত চোখগুলো তখন নিজেদের মধ্যে কথা বলার মাধ্যম হয়ে উঠত। সবার চোখের ভাষায় চরম দোটানার ছাপ ভেসে উঠত।

কিন্তু এই দোটানা বেশিক্ষণ স্থায়ী হতো না। আচমকা আপু বলে উঠত, সমস্যা নাই চল যাই। আজকে তো চাঁদরাত, কিছু বলবে না। তারপর যে কথা, সে-ই কাজ। কিন্তু যাওয়ার পর দেখা যেত, কিছু বলা তো দূরের কথা, কেউ কেউ খুব আপ্যায়ন করে বিদায় দিতেন। আর কেউ কেউ আমাদের পেয়ে জুড়ে দিতেন লম্বা আকারের খোশগল্প। আবার কারও কারও ব্যস্ততা দেখে আমরা নিজ থেকেই বিদায় নিয়ে চলে আসতাম।

এভাবে পুরো বাড়ি চক্কর দেওয়া শেষ হতো। বাড়ির ভেতরটা শেষ হলো, কিন্তু এখনো তো বাড়ির বাইরেটা বাকি।

বাকি থাকবে কেন? আমরা যাব না? অমুক মামাদের বাড়ি, তমুক আপুদের বাড়ি—ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে যাব না? যাব তো, কিন্তু বাড়ির কেউ দেখে যদি বকা দেয়। দিলে দেবে তাতে কি! আমরা তো আর প্রতিদিন ছোটাছুটি করি না। আজকে চাঁদরাত সবাই বুঝবে। নিজেদের মধ্যে এ রকম প্রশ্ন-উত্তরপর্ব শেষে বেরিয়ে পড়তাম বাড়ির বাইরের শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে দেখা করার জন্য।

কিন্তু কথায় আছে না, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যে হয়। প্রায় প্রায় আমাদের সঙ্গে এমনটা ঘটত। কারণ, ওই সব বাড়িতে রাস্তা পার হয়ে যেতে হতো। কিন্তু যেই যাওয়ার পরিকল্পনা করতাম, তখনই মনে হতো কেউ হয়তো আসছে। ওই দেখ দেখ, এটা অমুক না তমুক না ? চল পালাই!

কিন্তু এত সহজে তো হার মানা যাবে না। আমাদের কাছে অন্য আরও রাস্তা আছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেখি, একটু পরে যাই। এ রকম অনেক ফন্দি আটতে হতো আমাদের চাঁদরাতের মিশন সফল করার জন্য।

চাঁদরাতে বেশির ভাগ সময় ঘরে ফিরে দেখা যেত আপুর কাছে মেহেদি পরার জন্য একঝাঁক ছেলেমেয়ে মৌমাছির ভিড় করে বসে আছে। নিয়মানুসারে সে তার কাজে লেগে পরত। আমি এখন কী করি, আমার তো তখনো নিজের ফোন বা ফেসবুক-টেসবুক কিছু নেই। ঠিক তখন নির্দিষ্ট একটা সময়ের জন্য আম্মার ফোনের মালিকানা পেয়ে যেতাম। ফোনের মালিকানা পেয়ে স্কুলের আমাদের ছয়জনের টিমের সবাইকে ফোনকল করে শুভেচ্ছা বিনিময় করা হতো।

ফোনকলে থাকা অবস্থাতেই যাঁরা সব সময় বাড়ি থাকেন না কিন্তু ঈদ উপলক্ষে বাড়ি এসেছেন, তাঁরা সবার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতে আসতেন। অবচেতন মনে এখানেও জমত রংবেরঙের গল্প। আর এ রকম দৃশ্য শুরু হতে না–হতেই তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আসরের সদস্যসংখ্যা বাড়াতে ভুল করতাম না একদম।

এভাবে ধীরে ধীরে ছোট আসর বড় হতো। গল্প করে চাপার জোর কমে আসতেই আপুকে সামনে দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলতাম, হয়েছে এবার আমার হাতে মেহেদি পরিয়ে দাও। মেহেদি দেওয়া অবস্থায় চোখে যেন ঘুমের পাহাড় নেমে আসত। কিন্তু মেহেদি দেওয়া শেষে ঘুমাতে গেলেই মাথায় ঈদ নিয়ে বাহারি রকম পরিকল্পনা এসে ভর করত। এসব ভাবতে ভাবতে একসময় অবচেতন মনে ঘুমিয়ে পড়তাম। এভাবেই এক সুন্দর অনবদ্য সকাল দেখার প্রত্যাশা নিয়ে এই রাতের সমাপ্তি ঘটত আমাদের।

মুসলিমা জাহান
শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।