জন্মমুহূর্ত থেকেই সন্তানের নিরাপত্তা মা-বাবার চিন্তার বিষয়। গাড়িতে করে শিশুদের নিয়ে ভ্রমণে গেলে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কেননা, সামান্য অসচেতন হলেই বড় দুর্ঘটনার মুখে পড়তে পারেন।
অনেক সময় শিশুরা অন্যমনস্ক থাকে, যার ফলে ঝুঁকির আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির ২০২২ সালের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৮৮টি শিশু নিহত এবং ৭৯৪টি শিশু আক্রান্ত হয়। বিষয়টা কতটা দুঃখজনক, ভেবে দেখেছেন?
এসব ভয়াবহ দুর্ঘটনা রোধকল্পে সবার সচেতন পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে আর কোনো শিশুর জীবন অঙ্কুরেই বিনাশ হয়ে না যায়! যানবাহনের সুরক্ষা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে হওয়া উচিত। সাম্প্রতিক কালে বাড়তে থাকা সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। নিজের সুরক্ষার পাশাপাশি সমান গুরুত্বপূর্ণ হলো গাড়ির যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বিশেষ করে যখন গাড়িতে শিশুরা ভ্রমণ করে। সামান্য অসচেতন হলেই বড় দুর্ঘটনার মুখে পড়তে পারে।
গত বছরের ২৭ ডিসেম্বরে গেজেট আকারে প্রকাশিত বিধিমালায় শিশুযাত্রীর জন্য সিটবেল্ট বাঁধাসংক্রান্ত নির্দিষ্ট বিধান কর্তৃপক্ষ প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জারির কথা বলা হলেও শিশু–আসনের বিষয়ে কোনো বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। উচ্চগতির যুগে চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালনায় ভ্রমণের সময় শিশুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। অতএব, শিশুদের নিরাপদ পরিবহনের জন্য শিশুদের উপযোগী সুরক্ষিত আসন অত্যন্ত জরুরি।
উন্নত দেশের মতোই বাংলাদেশে শিশু সুরক্ষায় স্ট্যান্ডার্ড সিটবেল্ট দিয়ে গাড়িতে শিশুর আসন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে দুর্ঘটনায় শিশু সুরক্ষিত থাকে। কারণ, সড়ক দুর্ঘটনায় যখন বড় ধরনের কোনো সংঘর্ষ ঘটে, তখন দেখা যায়, মায়ের কোলে বসিয়ে রাখা শিশুটি ছিটকে গিয়ে মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে। যদি শিশুটি একটি শিশুনিরাপত্তা আসনে থাকত, তাহলে দুর্ঘটনার আঘাত থেকে রক্ষা পেত।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮। তবে আইনটি যুগোপযোগী হওয়া সত্ত্বেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ আইনে গতিসীমা লঙ্ঘনের বিধান বর্ণিত থাকলেও গতিসীমা নির্ধারণ কিংবা পর্যবেক্ষণের নির্দেশনা ও পরিকল্পনা উল্লেখ করা হয়নি। এ ছাড়া যাত্রীদের সিটবেল্ট ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা ও শিশুদের ক্ষেত্রে চাইল্ড রেস্ট্রেইন বা শিশুদের জন্য নিরাপদ আসন ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা আইনটিতে নেই।
একজন অভিভাবক হিসেবে গাড়িতে ভ্রমণ করার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে একটি হলো আপনার সন্তানকে নিরাপদ রাখা। গাড়িতে আপনার সন্তানের যে ধরনের আসন প্রয়োজন, তা নির্ভর করে আপনার সন্তানের বয়স, আকার, বিকাশের প্রয়োজনীয়তাসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর। একটি শিশু সুরক্ষা আসন, যাকে কখনো কখনো শিশু সুরক্ষা আসন, শিশু সংযম ব্যবস্থা, শিশু–আসন, শিশুর আসন, গাড়ির আসন বা একটি বুস্টার সিট বলা হয়। এটি এমন একটা আসন, যা বিশেষভাবে গাড়ির সংঘর্ষের সময় শিশুদের আঘাত বা মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনা ১ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্লোবাল রোড সেফটি পার্টনারশিপের এক তথ্যানুযায়ী, যানবাহনে শিশুদের জন্য সুরক্ষিত আসন ব্যবহার করলে ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে প্রায় ৭০ শতাংশ এবং বড় শিশুদের ক্ষেত্রে ৫৪ থেকে ৮০ শতাংশ শিশুমৃত্যুর হার কমবে।
ইউএনবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসের তুলনায় দ্বিতীয় ভাগে (এপ্রিল-জুন) সড়ক দুর্ঘটনায় শিশুমৃত্যুর হার ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়ে গেছে। দ্য ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এপ্রিল ২০২২ পর্যন্ত গত ২৮ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৬৭৪টি শিশুর মৃত্যু হয়। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) তথ্যানুসারে, যানবাহনে শিশুবান্ধব আসনের ব্যবহার শিশুদের সড়ক দুর্ঘটনায় আঘাতের ঝুঁকি ৭১ থেকে ৮২ শতাংশ হ্রাস করে। সড়কে শিশুমৃত্যু ঠেকাতে গাড়িতে সিটবেল্ট বাঁধা, যানবাহনে শিশুদের উপযোগী সিটের ব্যবস্থা করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
দুর্ঘটনায় শিশুদের আঘাত প্রতিরোধ করার সর্বোত্তম উপায় হলো গাড়িতে ভ্রমণ করার সময় তাদের সঠিকভাবে যত্ন নেওয়া। শিশু সুরক্ষার আসন এমন একটি আসন, যা বিশেষত বাচ্চাদের গাড়ির সংঘর্ষের সময় আঘাত বা মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে।
শিশু–আসনের পক্ষে কারণগুলোর মধ্য অন্যতম হচ্ছে সড়কে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে শিশু–আসন থাকায় শিশুকে সুরক্ষা রাখে, ধাক্কা ছাড়াই এবং সর্বাধিক গতির অসুস্থতার প্রভাবসহ একটি নিরাপদ ভ্রমণ প্রদান করে। সড়ক দুর্ঘটনায় শিশুমৃত্যুর হার বৃদ্ধির কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দেশের সড়ক ও সড়ক পরিবহন শিশুবান্ধব না হওয়া, গাড়িতে শিশুদের উপযুক্ত আসনের ব্যবস্থা না থাকা, সড়ক ও সড়ক পরিবহনব্যবস্থা শিশুদের জন্য নিরাপদ না করা ইত্যাদি।
আমাদের দেশে পরিবহনে শিশু–আসন তৈরি করার কোনো আইনি বিধিবিধান নেই। তাই বর্তমান নীতিমালায় শিশু–আসন বাস্তবায়নে একটি সংযোজন প্রয়োজন। দেশে সঠিকভাবে শিশুনিরাপত্তা আসন ব্যবহার করা হলে যাত্রীবাহী গাড়িতে শিশুমৃত্যু কমাতে সহায়তা করবে।
আমাদের দেশের গাড়িগুলো শিশু–আসন খুবই জরুরি। শিশু–আসনের ক্ষেত্রে নতুন আইন প্রণয়ন করে তা অতি দ্রুত বাস্তবায়ন করা হোক। প্রতিবছরে সড়কে আমাদের দেশে অভাবনীয় শিশুর প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। আর এই মৃত্যুর হাত থেকে শিশুদের সুরক্ষা রাখতে শিশু–আসন আইন প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন চাই।
সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-তে শিশুদের সুরক্ষিত আসন নিয়ে কোনো কিছু বলা নেই। কিন্তু আমাদের দেশের যানবাহনে শিশু-আসন খুবই জরুরি। তাই বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে যানবাহনে (বিশেষ করে ছোট গাড়িতে) শিশুদের জন্য সুরক্ষিত আসন প্রচলনে আইন আবশ্যক। পাশাপাশি সড়ক ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের ঘোষিত ‘সেফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচ’ অনুযায়ী একটি আলাদা আইন প্রণয়নের দাবি ঢাকা আহছানিয়া মিশনের। কারণ, বর্তমান আইনটি সম্পূর্ণরূপে মোটরযান–সংক্রান্ত আইন, যেখানে সড়ক ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি অনুপস্থিত।
তরিকুল ইসলাম
অ্যাডভোকেসি অফিসার, কমিউনিকেশন
রোড সেফটি প্রকল্প, ঢাকা আহছানিয়া মিশন।