একজন রুনা ম্যাম এবং এক ক্লাসে শিক্ষকের দুই নীতি

শত শত বছর পেছনের বাস্তব একটি গল্প। এক হাতে অমোঘ সত্য আর অন্য হাতে হেমলক বিষ শক্ত করে ধরে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছেন একজন মহান দার্শনিক। অবশেষে অগত্যা হেমলক পানে তার কায়া বেয়ে নেমে আসে অবশতার করুণ ঢল। প্রাণ হারালেও জ্ঞানের জগতে অপ্রাণ না হওয়া এই ভাস্বর দার্শনিকের নাম সক্রেটিস। এই গ্রিক দার্শনিক জীবদ্দশায় কিছুই লেখেননি; চিরকুট, চিঠি ও পুঁথি—কিছুই নয়। বই তো অনেক দূরের নজির। তো এই মহান শিক্ষক, যাঁকে বলা হয়ে থাকে ‘জ্ঞানের পিতা’, তাঁর সম্পর্কে পৃথিবীব্যাপী এত গবেষণা, এত জানার আগ্রহ কীভাবে তৈরি হলো?

হ্যাঁ, এখানেই চলে আসে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মধুর অভেদ্য ব্যাপারটি। তাঁর সম্পর্কে আমরা আজ ঠিক যা যা জানি, তা প্লেটো মারফত। এই প্লেটোই তাঁর বইয়ে-ডায়ালগে তাঁর শিক্ষক সক্রেটিসকে সাচ্চা জীবন দান করেছেন। অনেকে তো এটা ভাবে যে সক্রেটিস বলতে বাস্তবে কেউই নেই, ইহা শুধুই প্লেটোর বানানো একটি কাল্পনিক চরিত্রমাত্র।

গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের শিষ্য হলেন প্লেটো, আর মহান প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটল আর অ্যারিস্টটলের শিষ্য মূলত দুজন ছিলেন, যাঁরা কিনা যথাক্রমে থিওফ্রাস্টাস ও আলেকজান্ডার। আজকের দুনিয়ার আর পাঁচটা স্বাভাবিকের মধ্যে অস্বাভাবিক ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে কোনোটিতেই গ্রিক মনীষাদের এ রকম প্রগাঢ় পরিপূরকতার ছিটেফোঁটাও পাওয়া যায় না।

আজকাল একটি শ্রেণিকক্ষের গণ্ডির ভেতরের মধ্যে পরস্পর বিবদমান দুটি পক্ষের একটি হলো শিক্ষক আর আরেকটি নিঃসন্দেহে ছাত্রসকল। এখানে ‘সকল’ শব্দটি না ব্যাকরণের দিক থেকে নিপুণ, না গভীরতার দিক থেকে সঠিক। কারণ, অনেক শিক্ষকই যেন মেধাবী বা তথাকথিত শীর্ষ রেজাল্টধারীদের শিক্ষক আর তথাকথিত অমেধাবীদের কাছে যমদূতের ন্যায়। এ যেন ক্ষণে রাম, ক্ষণে রাবণ। এক ক্লাসে দুই নীতি। শিক্ষকের প্রতি যথাযোগ্য সমীহ রেখেই সখেদে প্রশ্ন করছি, এমনটি কেন?

একটি শ্রেণিকক্ষের প্রথম বেঞ্চে বসা শিক্ষার্থীরাই যেন হীরার টুকরা হয়ে ওঠে। শিক্ষকদের যত মনোযোগ, ভালোবাসা, আদর ও সমাদর যেন ওদের জন্য বিশেষরূপে বরাদ্দ অথচ ক্রমান্বয়ে এই মারপ্যাঁচে পিছিয়ে পড়ারা কি অধমই থেকে যাবে? ব্যাপারটি ঠিক অধ্যাপক রাগনার নাকসের তত্ত্ব ‘দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের’ মতোই। দরিদ্র ব্যক্তিরা ঘুরেফিরে সেই দরিদ্রই থেকে যাবেন।

আমার একদম স্পষ্ট মনে আছে আমার স্কুলজীবনের একটি বিশেষ স্মরণীয় দিনের কথা। ওই দিনটির আগে কখনো আমি স্কুলে কোনো ক্লাসেই টুঁ শব্দটি অবধি করতে পারতাম না। সবার কাছে পরিচিত বোবা ছেলেটি একদিন রুনা ম্যামের ক্লাসে একটি কবিতা পাঠ করিয়ে শোনানোতে সেকি তেলেসমাতি কাণ্ডটাই না ঘটেছিল সেদিন। সবাই আমাকে নিয়ে বিশেষ স্তুতি জপছিল। কিন্তু এখানে আসলে কারিশমাটা কার ছিল? হ্যাঁ, অবশ্যই তা শ্রদ্ধেয় রুনা ম্যামের। তার পর থেকে আমার আর কথা বলতে গিয়ে আটকাতে হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন আজ অবধি তিনটি ‘জাতীয় বিতর্ক’ করেছি এবং ডজনখানেক পুরস্কার শুধু বিতর্ক-বক্তৃতায় পাওয়া হয়ে গেছে। বলুন তো, আমি কার নিখুঁত আবিষ্কার? উত্তরটি দ্ব্যর্থহীনভাবে হবে, রুনা ম্যামের। শিক্ষকেরা হবেন একেকজন প্রকাণ্ড আবিষ্কারক।

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে মার্কিন দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানী জন ডিইউ বলেছিলেন, ‘একজন শিক্ষক হলেন চালক এবং পথপ্রদর্শক। তিনি গাড়ি চালিয়ে যাবেন, যে গাড়ির চালিকাশক্তির উৎস হলো শিক্ষার্থীরা।’ ক্রমবর্ধমান পুঁজিবাদের উত্থানের কাছে এই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক অনেকটাই অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলের জটলায় আটকা পড়ে যাচ্ছে। শিক্ষকেরা যেন ক্লাসের পড়াকে ‘সংবাদ শিরোনাম’ ভাবেন আর প্রাইভেট-টিউশনে থাকে সেটির ‘বিস্তারিত’। এ কারণে একটি আদর্শিক শ্রেণিকক্ষের যে ধর্ম, তা আর বজায় থাকে না। আর অপর দিকে আর্থিক বিপর্যস্ত শিক্ষার্থীরা ‘সংবাদ শিরোনাম’ শুনেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলেই তুষ্ট থাকে আর কখনো জীবদ্দশায় হয়তোবা ‘বিস্তারিত’ শোনা হয়ে উঠে না।

সালটা ১৯৯৩৷ এ দেশে চালু করা হয়েছিল ‘খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা’। ব্যাপারটি এমন ছিল যে দেশের হতদরিদ্র জনগণ খাদ্যের বিনিময়ে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাবে। দারিদ্র্যের ভারে নুয়ে পড়া মানুষগুলো যেন সন্তানদের ‘একবেলা’ আহারের ব্যবস্থা করতেই শিক্ষার প্রতি অসম্ভব আগ্রহ পেয়েছিল। সে দেশেই আজ সন্তানদের লেখাপড়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি ব্যয় করতে হয় বাংলাদেশের অভিভাবকদের।

ইউনেসকোর ২০২১-২২ গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্টে জানা যায়, শিক্ষার পেছনে গড় খরচ বেড়েছে ৮০ শতাংশ। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় ৭ শতাংশ পরিবারকে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে অজস্র ঋণ নিতে হয়। এর পেছনে অতিরিক্ত টিউশন ফি, স্টেশনারির দাম ও সরকারের আনুপাতিক অপর্যাপ্ত বরাদ্দও দায়ী। এত খরচ মেটানোর সাধ্য কি সবার আছে? আর তাই সমীক্ষা অনুসারে, বর্তমানে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার প্রায় ১৯ শতাংশ আর মাধ্যমিকে ৩৯ শতাংশ। কী ভয়াবহ!

কবি কাজী কাদের নেওয়াজের লেখা ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতার লাইনগুলো আজ জীবন্ত হয়ে উঠলে এ দেশ সারা বিশ্বে পরিচিত হবে শ্রেষ্ঠ ‘সোনার খনিওয়ালা’ দেশ হিসেবে। সে সোনা মাটির নিচে নয়, ওপরে তৈরি হয় একটু একটু করে আদর্শ শিক্ষকের জাদুকরি হাত থেকে। এত দেশ হবে সোনার দেশ, মানুষ হবে সোনার মানুষ আর জাতি হবে সোনার জাতি। শিক্ষকেরা এই সোনার দেশ গড়ার সবচেয়ে অগ্রগামী নেতা আর ছাত্ররা তার ভিত।

নাবিল হাসান
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]