পুলিশ ভেরিফিকেশনে হয়রানি আদৌ কি দূর হবে

বাংলাদেশ পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ সেবা হলো পুলিশ ভেরিফিকেশন তথা পুলিশ ক্লিয়ারেন্স বা পুলিশের ছাড়পত্র। বিভিন্ন কাজে পুলিশের এই ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয়। তবে বর্তমানে পুলিশের এই ছাড়পত্র নিয়ে অনেকের থাকতে হয় ভীত আর আশঙ্কায়। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, সেবা নিতে গিয়ে কেন এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে?

বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে টেকনিক্যাল স্কুলের মাধ্যমে বেকার যুবক-যুবতীদের বিভিন্ন কারিগর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে, এর মধ্যে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ অন্যতম। এ প্রশিক্ষণটি দেওয়ার পরে প্রশিক্ষিতদের সম্পূর্ণ সরকারি খরচে পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স করে দেওয়া হচ্ছে। যাতে প্রশিক্ষিত হওয়ার পর সহজেই বেকারদের কর্মসংস্থান হয়ে যায়। শরীয়তপুরের জাজিরা সদরের বাসিন্দা ‘ক’ আর ‘খ’ দুই বন্ধু শরীয়তপুর টেকনিক্যাল স্কুল থেকে সেই প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য বিআরটিএ’র পরীক্ষা শেষে এখন বাকি পুলিশ ভেরিফিকেশন। বলে রাখি, পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রয়োজন হয়। তবে অপেশাদারের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় না।

যথারীতি ‘ক’ আর ‘খ’ নামে পুলিশ ভেরিফিকেশন আসল। তাদের বাড়ি জাজিরা উপজেলা সদরে তবে তাদের ভেরিফিকেশনের দায়িত্ব পড়ল পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় কর্মরত পুলিশের এক কর্মকর্তার কাছে। এখন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তার মতো করে গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে তদন্ত করবেন। কিন্তু তা না করে উক্ত কর্মকর্তা সেবাপ্রার্থী ‘ক’ ও ‘খ’-এর সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে বললেন, 'আপনারা বাড়ির দলিল, পর্চা, নাগরিক সনদ, নিজের এবং মা–বাবার জাতীয় পরিচয়পত্র ও কিছু খরচাপাতি নিয়ে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় আসুন।’

এ কথা শোনার পরে সেবাপ্রার্থীরা বললেন, ‘আপনি তদন্ত করতে আমাদের বাড়িতে আসবেন তো তখন নাহয় আপনার চাহিদা মোতাবেক কাগজপত্র আপনাকে দেব। নয়তো আমাদের এখান থেকে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানা প্রায় ২০ কিলোমিটার দুরে। যেতে কষ্ট হয়ে যায়।’

সেবাপ্রার্থীদের মুখে এমন কথা শুনে পুলিশ কর্মকর্তা হয়তো বুঝে গিয়েছেন তাঁরা সচেতন নাগরিক। এরপরও তিনি পূর্বের দিনের মতো পুলিশ ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে যথাযথ দায়িত্ব পালনে অবহেলায় মগ্ন থাকতে দ্বিধাবোধ করলেন না। তিনি এই সেবাপ্রার্থীদের আবারও ফোন করে একই কথা বললেন। এ তো গেল দুজন ভুক্তভোগীর কথা।

একইভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন আরও অনেকে। এদের মধ্যে কয়েকজন টাকা দিয়ে ভেরিফিকেশন সম্পন্ন করতে বাধ্যও হয়েছেন। আরেকজন ভুক্তভোগী জাজিরা উপজেলা সদরের বাসিন্দা ‘গ’। তিনিও শরীয়তপুর টেকনিক্যাল ট্রেইনিং সেন্টার (টিটিসি) থেকে পেশাদার ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আর একইভাবে তাকে যাচাই করতেও পুলিশ ভেরিফিকেশন আসে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার একই কর্মকর্তার কাছে। ‘গ’-কেও একই কথা বলেন—কিছু খরচাপাতি নিয়ে পদ্মা থানায় দেখা করেন। পরে এই ভুক্তভোগী সেটি না করায় প্রায় ৩ মাস পরেও তিনি পুলিশ ভেরিফিকেশনের ফলাফল পাননি।

রহমান আলী হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। তাঁকে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন এক আত্মীয়। সময় ক্ষেপণ না করে রহমান আলীর দিনমজুর বাবা ও পরিবারের সকলে মিলে পাসপোর্ট করার ব্যবস্থা করলেন। যথারীতি পাসপোর্টের আবেদন সম্পন্ন করার পর পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার অপেক্ষা। এরপরেই ভিসা পেয়ে রহমত আলী যেতে পারবেন মালয়েশিয়া। ধরবেন পরিবারের হাল। দিনমজুর বাবাকে করবেন নিশ্চিন্ত। পরে পাসপোর্টের খোঁজের গিয়ে জানতে পারে তার পাসপোর্টের জন্য এখনও পুলিশ ভেরিফিকেশন সম্পন্ন হয়নি। কয়েক দিন পর জাজিরা থানায় নিয়োজিত এক পুলিশ কর্মকর্তা ফোন করে জানান, পাসপোর্টের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের দায়িত্ব তাঁর কাছে এসেছে। রহমান আলী কথামত কাগজপত্র নিয়ে থানায় গেলে তিনি তাঁকে বললেন, কাগজপত্র অনুসারে জন্ম তারিখের সাথে আপনার চেহারার মিল নেই। এসব কথা বলে তাঁকে ভয় দেখান ওই কর্মকর্তা। তারপর কিছু টাকা হাতে গুঁজে দিলে বিষয়টির সমাধান হয়। কয়েকদিন পর পাসপোর্টও তাঁর হাতে আসে।

এমন শত শত ভুক্তভোগীকে পুলিশ ভেরিফিকেশন সম্পন্ন করতে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। শুধু জাজিরা তথা শরীয়তপুর জেলায় তা নয়। দেশের অন্যান্য জেলায়ও। এতেই বোঝা যায়, এ দেশে জনগণকে নির্বিঘ্নে সেবা দিতে যত ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তার মধ্যেই অসাধু কর্মকর্তারা ফাঁকফোকর বের করে নেয়। নিজেদের মন্দ চরিতার্থ পূরণে জনগণকে হয়রানি করে।

পুলিশ ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রথমেই সেবাপ্রার্থীর স্থায়ী কিংবা বর্তমান ঠিকানায় গিয়ে যাচাই-বাছাই করার কথা। কিন্তু তারা তা না করে দায়িত্বের অবহেলা তো করছেনই, থানায় ডেকে নিয়ে কাগজপত্রে বিভিন্ন ভুলের অজুহাত তৈরি করে সেবাপ্রার্থীদের থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। আবার বাড়িতে গেলেও তাঁদের মেহমানদারি তো করতেই হয়, বাড়তি অর্থ না দিলেও হয় না।

এক পুলিশ কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলাম, পুলিশ ভেরিফিকেশনের দায়িত্বপ্রাপ্তদের সরকার কোনো সম্মানী দেয় না? তিনি বলেন, দেয়, তবে সামান্য। অথচ তারা বেতনও পাচ্ছেন, আবার দায়িত্ব পালন করলে সম্মানীও পাচ্ছেন। এরপরও তাদের জনগণকে হয়রানি করতে হবে, তাদের থেকে কিছু খরচাপাতি আশা করতে হবে। এমনটি কেন হবে?
এ দেশের সাধারণ মানুষ কি কখনো পুলিশ ভেরিফিকেশনের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ সেবা হয়রানি ও দুর্নীতিমুক্তভাবে পেতে সক্ষম হবে?

মো. পলাশ খান
সমাজকর্মী ও সাংবাদিক, শরীয়তপুর