অবহেলা নয়, লোকপ্রশাসনে শিক্ষা ক্যাডার চাই

দেশের প্রথম সারির ১৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অন্যতম বিষয় লোকপ্রশাসন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিষয়টির সূচনা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য বিষয় হিসেবে এটি অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

লোকপ্রশাসন বিষয়টি সরকারের নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। বিসিএসে আরবি, সংস্কৃতির মতো বিষয়েও শিক্ষা ক্যাডার আছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বলতে হয়, লোকপ্রশাসনের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শিক্ষা ক্যাডার নেই। নেই বিশেষ ক্যাডার, সুবিধা নেই প্রশাসন ক্যাডারেও। অথচ একজন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পেতে হলে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে হয়।

লোকপ্রশাসনের নামে বাংলাদেশে ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়’ আছে। সেখান থেকে সরকারি কর্ম কমিশন-পিএসসিতে জানানো হয় কোন ক্যাডারের জন্য কতগুলো সিট খালি। ২০১৯ সালের দেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একযোগে দাবি জানিয়েছিল লোকপ্রশাসনকে শিক্ষা ক্যাডারে যুক্ত করার। এ সময় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিভিন্ন বৈঠক হয়েছিল ফলে আশার আলো কিছুটা জেগে ছিল। হঠাৎ করোনার কারণে সব আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়।

সরকারি প্রশাসনের রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান,  আইন, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ, সরকারি নীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্কসহ কীভাবে দক্ষ প্রশাসক হতে হয় ইত্যাদি পড়ানো হয় লোকপ্রশাসনের শিক্ষার্থীদের। বর্তমানে ২৬টি ক্যাডার সার্ভিস রয়েছে। যেখানে ক্যাডারদের ফাউন্ডেশন ট্রেনিং কোর্সে লোকপ্রশাসনের ওপর ১৫০০ নম্বরের পরীক্ষা হয়। অন্যদিকে একজন লোকপ্রশাসনের শিক্ষার্থী এই বিষয়ে ৪-৫ বছর অধ্যয়নই করেন।

লোকপ্রশাসন সরকারের যাবতীয় কর্মপরিধি জনগণের চাহিদা পূরণের জন্য নানাবিধ জনকল্যাণমূলক পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রশাসন সরকারের কেন্দ্রে অবস্থান করে। লোকপ্রশাসন শুধু প্রশাসনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বিভিন্ন সেমিস্টারে সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতিসহ অনেক কোর্স পড়ানো হয় এখানে।

টেকনিক্যাল ক্যাডারে মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের যে বিষয় আছে সেখানে অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে পারে না। ফলে টেকনিক্যাল ক্যাডার থেকে বঞ্চিত লোকপ্রশাসন। বাংলাদেশে ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার বিষয় থেকে পাস করা অনেক শিক্ষার্থী এখন পেশা হিসেবে নিচ্ছেন পুলিশ, প্রশাসন, পররাষ্ট্র , করসহ বিসিএসের বিভিন্ন পদ। এসব ক্যাডারে যদি ডাক্তার এবং ইঞ্জিনিয়ারদের যেতে হয়, কেন তারা মেডিকেল ও প্রকৌশলী/প্রযুক্তি নিয়ে পড়েছেন, এমন প্রশ্ন ওঠতেও আমরা দেখি।

গত ৪১তম বিসিএসে লোকপ্রশাসনের শিক্ষার্থীরা অনেক দুঃখ ও ক্ষোভ  প্রকাশ করেন। অনেকের শিক্ষা ক্যাডার পছন্দের তালিকা থাকলেও নিয়মের শিকল থেকে বাইরে যেতে পারেননি। বিসিএসের ফলাফল বিশ্লেষণ: পিএসসি’র তথ্য মতে ৩৬ বিসিএসে ৪.৩০ শতাংশ, ৩৭ বিসিএসে ৬.০ শতাংশ, ৩৮ বিসিএসে ৭.৭১ শতাংশ পদে ডাক্তার, প্রকৌশল ও কৃষি ডিগ্রিধারীরা প্রশাসন, পররাষ্ট্র, পুলিশের মতো সাধারণ ক্যাডারে ঢুকেছেন।

শুধুমাত্র ৪১ বিসিএসে  প্রশাসনে ৩২৩ জন, পুলিশে ১০০ জন, পররাষ্ট্রে ২৫ জনসহ সাধারণ ক্যাডারে প্রায় ৮০০ জনকে সুপারিশ করে পিএসসি। সাধারণ ক্যাডারে সিংহভাগ চিকিৎসক-প্রকৌশলীদের জয়জয়কার। ২৫ জনের মধ্যে ১৫ জন বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের।

এবার একটু প্রশাসন ক্যাডারের দিকে নজর দেওয়া যাক, এখানে প্রকৌশলীদের আধিক্য; বুয়েটের ৪৫, চুয়েটের ২০, বুটেক্স ও কুয়েটের ২০, শাবিপ্রবিতে ৮, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগগুলোয় ৩০, হাবিপ্রবিতে ৩ জন। শুধু ৪১ বিসিএসে নয় বিগত ৪-৫টি বিসিএসে একই চিত্র।

পররাষ্ট্র ক্যাডারের সুপারিশ প্রাপ্ত প্রথম থেকে সপ্তম পর্যন্ত মেধা তালিকা বুয়েটের দখলে। প্রকৌশলী ও চিকিৎসকেরা যদি পররাষ্ট্র, কর, প্রশাসন ক্যাডার হতে পারেন তাহলে লোকপ্রশাসন বিষয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা কেন শিক্ষা ক্যাডারের সুযোগ পাবে না।

লোকপ্রশাসন বিষয়ে শিক্ষা ক্যাডার যুক্ত করলে, মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা পেশায় সুযোগ সৃষ্টি হবে। লোকপ্রশাসনের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা, কূটনীতি, প্রশাসনের কাজ প্রত্যক্ষভাবে দর্শন করে। বিভিন্ন সেমিস্টারে শিক্ষকেরা অ্যাসাইনমেন্টে এসব কাজ দিয়ে থাকেন। শিক্ষা ক্যাডার না থাকায় বিসিএসের অধিকাংশ আসন থেকে লোকপ্রশাসনের শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত। বিসিএসের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবান সরকারি চাকরিতে লোকপ্রশাসন অত্যন্ত উপেক্ষিত ও অবহেলিত। পিএসসি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে সবিনয়ে বলতে চাই লোকপ্রশাসন বিভাগকে শিক্ষা ক্যাডারের  অন্তর্ভুক্ত করা এখন সময়ের দাবি।

উল্লেখ্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য স্যার পি.জে. হার্টজ ১৯২০ থেকে  ১৯২৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলেন। বিশেষ করে প্রশাসনিক দক্ষতার কথা বিবেচনা নিয়ে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

মো. সিদ্দিকুর রহমান সিদ্দিক
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর