বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা কেন?

প্রতীকী ছবি
অলংকরণ: আরাফাত করিম

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, আত্মহত্যার কারণ ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই তাদের ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশাগ্রস্ত। কিন্তু কেন অনেক স্বপ্ন নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে এসে অসীম সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়েও একজন শিক্ষার্থী হতাশ হয়ে যাচ্ছে?

সরকারি চাকরির ভেতরেই কি লুকিয়ে আছে আত্মহত্যার অন্যতম কারণ? দেশের তরুণ সমাজ আর তাদের অভিভাবকদের মধ্যে সরকারি চাকরি নিয়ে যে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছে সেটি অভূতপূর্ব। দিন দিন সরকারি চাকরির প্রতি শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের আগ্রহ যেন ব্যাধিতে রূপ নিচ্ছে। এই ব্যাধি সৃষ্টির পেছনে শুধু শিক্ষার্থীদের দোষ দেখলে হবে না। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এর জন্য যথেষ্ট দায়ী। সাংবাদিকতায় পড়ে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই সাংবাদিক হতে চান না, নাটকে পড়ে অনেকে থিয়েটার কর্মী হতে চান না, কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়ে যোগ দেন পুলিশে। ডাক্তাররা পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার চিন্তা করেন, যার হওয়ার কথা পদার্থবিজ্ঞানী, তিনি ট্যাক্স অফিসার!

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিসহ পাবলিক লাইব্রেরিগুলোতে এখন আর সাধারণ মানুষ বসার জায়গা পায় না। ভোর থেকেই ছেলে-মেয়েরা লাইন দিয়ে লাইব্রেরিতে আগে প্রবেশ করার প্রতিযোগিতায় নামে। ছেলেমেয়েরা কোনোমতে স্নাতক শেষ করার অপেক্ষায় থাকে। স্নাতক শেষ হয়ে যায়, আর ক্লাসে আসার গরজ করে না। অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী স্নাতক ডিগ্রি নিচ্ছে বিসিএস পরীক্ষার জন্য ফর্ম তোলার জন্য। শুধু বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য যদি ছাত্র-ছাত্রীরা স্নাতক পর্যন্ত অপেক্ষা করে তাহলে এতসময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। চার-পাঁচ বছর ধরে স্নাতক পড়ার কী দরকার? শুধু বিসিএস ক্যাডার হওয়া যদি জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণায় পরিবর্তন আনতে হবে।

পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নানাবিধ সমস্যা থাকবেই। পরিবার ভেঙে যেতে পারে, সমাজ ও রাষ্ট্র সবার সমস্যার সমাধান নাও দিতে পারে। তাই বলে আত্মহত্যা সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য পথ হতে পারে না।

সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এই সমীক্ষার তথ্য বলছে, ২০২২ সালে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার ১০১টি ঘটনা ঘটে।

পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের মানোন্নয়ন করতে হবে, এতে কোনো শিক্ষার্থী হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে শিক্ষকেরা সহজেই বুঝতে পারবেন এবং হতাশা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে। কোনো শিক্ষক যেন কোনো শিক্ষার্থীর স্বপ্ন ভঙ্গের কারণ না হন, শিক্ষকেরা যেন হন শিক্ষার্থীদের সব থেকে বড় আশ্রয়, স্বপ্ন গড়ার কারিগর। সর্বোপরি আমাদের একটি বিষয় অবশ্যই মনে রাখতে হবে জীবনের জন্য স্বপ্ন, স্বপ্নের জন্য জীবন নয়।

নিজেকে শেষ করে দেওয়ার আগে বাবা, মা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধবদের কথা মনে করে নিজের জীবনে তাদের অবদানের কথা মনে করলে কেউ আত্মহত্যা করতে পারে না। কোনো শিক্ষক যদি বৈষম্য করে, তাঁর ওপর রাগ করে কিংবা হতাশ হয়ে নিজেকে হত্যা করার কি কোনো মানে আছে? বৈষম্য সৃষ্টিকারী সেই শিক্ষক থেকে অনেক বেশি আপন, অনেক বেশি কাছের, অনেক বেশি ভালোবাসার মানুষ নিজের বাবা-মা, ভাই-বোন। যারা প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেন তাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অন্যের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে পরে হতাশ হয়ে আত্মহত্যা করার কোনো মানে হয় না। ভালোবাসতে হবে, পাশাপাশি সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীরা যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় জ্ঞানার্জনের জন্য, গবেষণার জন্য, সেখানে আমাদের দেশে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় একটা ভালো চাকরির জন্য। কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। তবে যদি একটি গবেষণানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা যায়, তরুণদের মাঝে যদি ভালো প্রতিষ্ঠানের কর্মী হওয়ার পরিবর্তে উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহ তৈরি করতে পারে তবে হয়তো কিছুটা হলেও শিক্ষার্থীদের হতাশা দূর করা সম্ভব হবে।

পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের মানোন্নয়ন করতে হবে, এতে কোনো শিক্ষার্থী হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে শিক্ষকেরা সহজেই বুঝতে পারবেন এবং হতাশা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে। কোনো শিক্ষক যেন কোনো শিক্ষার্থীর স্বপ্ন ভঙ্গের কারণ না হন, শিক্ষকেরা যেন হন শিক্ষার্থীদের সব থেকে বড় আশ্রয়, স্বপ্ন গড়ার কারিগর। সর্বোপরি আমাদের একটি বিষয় অবশ্যই মনে রাখতে হবে জীবনের জন্য স্বপ্ন, স্বপ্নের জন্য জীবন নয়।

সাকিবুল হাছান ঢাকা কলেজ, ঢাকা