সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকেই মানুষের অন্যতম তাগিদ নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। খাদ্যের জোগাড় করতে গিয়েই মানুষ ভেবেছে তার অন্য সব চাহিদার কথা। সভ্যতার শুরু থেকেই যত টিকে থাকার লড়াই, তার মূলে কাজ করেছে মানুষের প্রধানতম স্বার্থ—খাদ্য। তাই যুগে যুগে নিজের অধিকার আদায়, শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনসহ সব আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল খেয়ে-পরে নিষ্কণ্টক জীবনযাপনের স্বপ্ন। কিন্তু সভ্যতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যুগ বদলেছে, দেশ বদলেছে, বদলেছে জীবন।
গ্রামে এখনো দরিদ্র মানুষ আছে কিন্তু অনাহারে থাকা মানুষ আর নেই। এখনো আঁতুড়ঘরে ভূমিষ্ঠ শিশুটি শেষ চিৎকার দিয়ে চিরবিদায় নেয়, তবে তার সংখ্যা অনেক কম বা নেই বললেই চলে। গ্রামের শিশু-কিশোরদের এখনো বাবার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হয়, তবে বিদ্যালয় থেকে ফিরে।
এক-দুই দশক আগেও গ্রামীণ কৃষিজমিতে গরু-মহিষ দিয়ে হাল-চাষের ব্যবস্থা করতেন যে কৃষক, এখন সেই কৃষক অনায়াসেই ট্রাক্টর দিয়ে জমি কর্ষণ করছেন, বীজ বুনছেন, সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করছেন। গতানুগতিক পুরোনো চাষাবাদ পদ্ধতিতে কৃষি উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব নয় এ যুগে, এটা গভীরভাবে উপলব্ধির পর এখন বেশির ভাগ গ্রামের কৃষক যুগোপযোগী বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে চাষাবাদের প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন।
চারদিকে যখন বহুমুখী সমস্যার বেড়াজাল তখন কৃষিই হতে পারে মুক্তির পথ।
আগামী দশকে আমরা যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারি, তা হলো ২০৩১ সাল নাগাদ ১১ মিলিয়ন টনের বেশি খাদ্যশস্যের ঘাটতি হতে পারে, যা গত এক দশকে বার্ষিক গড় খাদ্যশস্য আমদানির দ্বিগুণ। এ ঘাটতি মেটানোর একমাত্র উপায় উচ্চহারে উৎপাদন বাড়ানো। কিন্তু গত দশকের অভিজ্ঞতা ততটা আশাব্যঞ্জক নয়। আরেকটা উপায় হতে পারে অন্য খাদ্যশস্য উৎপাদনের দিকে যাওয়া। একই সঙ্গে দরকার হবে খাদ্যবহির্ভূত শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি যেন খাদ্যশস্যের ক্ষতির চেয়ে কম না হয় সেটি নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশে কৃষির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বাজার ব্যবস্থাপনা। দুর্বল ব্যবসায়িক নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের কৃষিবাজার। সকালের ৫০ টাকা কেজি দরের পেঁয়াজ বিকেলে হয়ে যায় ১৮০ টাকা। আবার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সন্ধ্যায় নেমে আসে ১০০ টাকায়। ওয়াজ-নসিহত করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার নজির পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। যদিও কৃষক ও ভোক্তার স্বার্থ দেখাশোনা করার জন্য আছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ এই সংস্থার সক্ষমতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। নচেৎ কৃষককে বারংবার হোঁচট খেয়েই যেতে হবে দোদুল্যমান বাজার ব্যবস্থার কাছে।
এ ছাড়াও, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বসতবাড়িতেই ফসলের উপযোগী ইকো-সিস্টেম রয়েছে। বাংলাদেশে আনুমানিক ১৭.৫ মিলিয়ন বসতবাড়ি রয়েছে যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ শাকসবজি ও ফল উৎপাদন করে সংশ্লিষ্ট পরিবারের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এর মধ্যে মাত্র ১৩ ভাগ গৃহচত্বর সবজি চাষের আওতায় এসেছে। বসতবাড়িতে পরিকল্পিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সবজির বাগান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পারিবারিক খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন, পারিবারিক পুষ্টি পূরণ করা সম্ভব। পরিবারের সকল সদস্যের শ্রম, সময় উৎপাদন কাজে লাগিয়ে স্ব-স্ব কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার সম্ভাবনাও আছে। এমনকি বসতবাড়ির সবজি বাগানের মাধ্যমে বিদ্যমান সম্পদের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার করে পরিবেশ সংরক্ষণেরও অসীম সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমান সরকার একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মাধ্যমেও পুষ্টি চাহিদা পূরণে কাজ করছে।
কৃষকের জানালা নামে একটি সেবা রয়েছে কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের। এটি হচ্ছে মাঠ ফসলের বিভিন্ন সমস্যার ধারণকৃত ছবির তথ্য ভান্ডার যা ব্যবহার করে সমস্যা নির্ণয় এবং একই সঙ্গে সমস্যার পরিবেশবান্ধব সমাধান করবে এটি। যে কোনো কম্পিউটার বা স্মার্টফোনে এটি ব্যবহার করা যায় যার ফলে প্রান্তিক কৃষক এখন ঘরে বসেই তাঁর ফসলি জমির সমস্যার সমাধান করছেন।
শুধু তাই নয় কৃষির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ খাত ও এগিয়ে চলেছে সমান তালে। সরকারি ও বেসরকারি হিসাবে, দেশে প্রতিবছর গবাদিপশুর খামারির সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই এখন তরুণ এবং ছাগল পালনে নারীরা সবচেয়ে এগিয়ে। গবেষকেরা বলছেন, সীমিত জায়গার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে মাছ ও মুরগি সমন্বিত চাষ করা যায় এবং এ ধরনের সমন্বিত চাষের ফলে অল্প খরচে বেশি মাছ উৎপাদন সম্ভব হয়। তাঁরা বলছেন, এ পদ্ধতিতে মাছের জন্য আলাদা করে সার বা খাদ্য দেওয়ার প্রয়োজন হয় না বরং মুরগির উচ্ছিষ্টই মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর মিশ্র এ চাষ পদ্ধতিতে প্রতি শতাংশে ২০ থেকে ২৫ কেজি মাছ উৎপাদন সম্ভব। তাছাড়া সমন্বিত পদ্ধতিতে শুধু মুরগিই নয়, হাঁসও চাষ করা যায়।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, জাতীয় কৃষিনীতি, জাতীয় বীজনীতি, জাতীয় খাদ্যনীতি ও এসডিজির সঙ্গে সংগতি রেখে দেশের জনগণের পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য নিরাপত্তা বিধান করতে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, পশ্চাৎপদ নৃগোষ্ঠীর জন্য পাহাড়ি অঞ্চলে ফলের বাগান সৃজন ও সবজি আবাদের বিস্তার এবং অনুন্নত চর ও হাওরাঞ্চলে সমন্বিত কৃষি সহায়ক প্রকল্পসহ বহুবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। এক ও দুই ফসলি জমিগুলোকে চার ফসলি জমিতে পরিণত করে শস্যের নিবিড়তা উন্নীত করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য উৎপাদনকালীন, বাজারজাতকালীন, প্রক্রিয়াজাতকালীন, রন্ধনকালীন ও পরিবেশনকালীন সময়ে খাদ্য নিরাপদ ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন রাখতে করণীয় বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
পরিশেষে, স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট অর্থনীতির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কৃষিকে সম্প্রসারণ, সমসাময়িক সমস্যা সমাধান ও প্রান্তিক কৃষকের কার্যকরী অংশগ্রহণ ব্যতীত মুক্তি অসম্ভব।
নওশীন তাবাসসুম
ইন্টার্ন শিক্ষার্থী
ভেটেরিনারি মেডিসিন অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স অনুষদ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর