পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কি হতাশা তৈরির কারখানা

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে উচ্চশিক্ষা শিক্ষার্থীদের হতাশা তৈরির কারখানায় রূপান্তরিত হয়েছে। প্রতিবছর শিক্ষা খাতে প্রয়োজন অনুসারে বাজেট বৃদ্ধি না করা ও ইউসিজির সঠিক তদারকির অভাব এর অন্যতম কারণ। বাজেট বরাদ্দ থাকলে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ব্যবহৃত হয়, কিন্তু শিক্ষার্থীদের মান উন্নয়নের জন্য সেই বরাদ্দ কতটুকু ব্যবহৃত হয়, সেই হিসাবটা মেলে না।

অধিকাংশ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার গণ্ডি পার করেছেন, কিন্তু জানেন না, কীভাবে গবেষণা করতে হয়। তাহলে উচ্চশিক্ষার মানেটা কি শুধু চাকরির পেছনে ছুটে চলা? যদি চাকরির পেছনে ছুটে চলা যৌক্তিক হয়, তাহলে উচ্চশিক্ষার মর্মটা রইল কোথায়? বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের যথার্থ মূল্যায়ন করা হয় না বলেই শিক্ষার্থীরা উন্নত দেশে পারি জমাচ্ছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা বিষয় খুব আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে। ঘটনা এমন ছিল, ‘একজন স্নাতকসম্পন্ন শিক্ষার্থী সরকারি চাকরির আশায় এক লক্ষ আশি হাজার টাকা খরচ করেছেন, তাঁর চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে চাকরি পরীক্ষার অসংখ্য প্রবেশপত্র।’ সেখানে হয়তো একজন শিক্ষার্থীর মনের ভাব প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু প্রতিবছর হাজার শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার গণ্ডি থেকে বের হন, তাদের মনের ভাব কেউ শুনছে? গত বছর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেল, একজন শিক্ষার্থী সার্টিফিকেট আগুনে পুড়িয়ে ফেলছেন, তারপর সেই শিক্ষার্থীকে এক মন্ত্রী মানবিক দিক বিবেচনা করে চাকরি দিয়ে দিলেন। আর অন্য শিক্ষার্থীরা শূন্য হাতে বসে রইলেন। তার মানে উপলব্ধি করা সহজ, আমাদের উচ্চশিক্ষা বলতে কী শেখানো উচিত, আর আমরা শিখছি কী? মাকাল ফলের মতো এসব শিক্ষাব্যবস্থা থেকে দিনশেষে সার্টিফিকেট ছাড়া আর কিছু আশা করে না সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া দরকার আমদের দেশের উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠগুলোর দিকে। দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গ্রাম্য অঞ্চলে গড়ে তোলা হয়, যার কারণে উন্নত প্রযুক্তি ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নগণ্য। উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত একজন শিক্ষার্থী যদি গবেষণায় আগ্রহ দেখান, তখন প্রথমে তাঁর পরিবারের সংকটের কথা চিন্তা করতে হয়। যেখানে মাসিক খরচ চালাতে হিমশিম খান শিক্ষার্থীরা, সেখানে গবেষণা তো বিলাসিতা হবেই। সাধারণ শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া হলেও তা নামমাত্র। আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে নানা সংকট ও শিক্ষক রাজনীতির মধ্য দিয়ে, তাই সেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিরুপায়।

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসনসংকট, শিক্ষকসংকট, যাতায়াতে সংকট, ক্লাসরুমের সংকট নানা সংকটে জর্জরিত হয়ে থাকে বারো মাস। আরেকটা বিষয় পরিষ্কার করা দরকার, বর্তমানে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় ফলাফল ভালো করার কৌশল রপ্ত করে এবং মুখস্থ ও আবৃত্তি কৌশলগুলো শিখতে অনুপ্রাণিত হয়। শেখার মূল্যায়ন পরিচালিত হয় মূলত লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে। প্রশ্নের সঠিক উত্তর না দেওয়ার কারণগুলো পর্যালোচনা করা হয় না এবং কোর্স শিক্ষক গ্রেড প্রদানের মাধ্যমে ছাত্রের মূল্যায়ন করে থাকেন। এ পদ্ধতিতে কর্মজীবনে তারা চিন্তা করার, সমস্যা সমাধান এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা যে প্রক্রিয়ায় পরিচালিত হচ্ছে, তা দিয়ে যুগোপযোগী দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা অত্যন্ত দুরূহ।

এসব কারণে দেশে শিক্ষিত শ্রেণির ভবিষ্যৎ কতটুকু উজ্জ্বল, তার তথ্যচিত্র দেখতে পাই, গত বছরের আগস্টে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জরিপ থেকে। তাদের তথ্য অনুসারে দেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর শতকরা ৪৭ ভাগ বেকার। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে যুবগোষ্ঠীর বড় অংশ আর্থসামাজিক ঝুঁকির মধ্যে আছে। বৈষম্য আর গুণগত শিক্ষার অভাবে ৭৮ শতাংশ তরুণ মনে করেন, পড়াশোনা করে তাঁরা চাকরি পাবেন না, গরিব শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ হার ৯০। চাকরি, পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণে নেই ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণের। আর ২০১৯ সালে বিআইডিএসের এক গবেষণায় দেখা যায়, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩.৩২ শতাংশ। অন্যদের মধ্যে ৪৭.৭ শতাংশ সার্বক্ষণিক চাকরিতে, ১৮.১ শতাংশ পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত। তার মানে কতটুকু বিপর্যয় দেশের উচ্চশিক্ষায়, তা আন্দাজ করতে বাকি থাকার কথা নয়।

তবে বর্তমান সরকার শিক্ষাব্যবস্থার যতটুকু আধুনিকায়ন করেছে, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি না করে তাদের মান এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন গুরুত্ব দেওয়া হবে, এটাই প্রত্যাশা। উন্নত দেশগুলোর মতো উচ্চশিক্ষায় সীমাবদ্ধতা দরকার, যাতে বিভিন্ন চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা কম হয়। কারণ, বেকারত্বের হার যত বাড়বে শিক্ষার্থীরা উন্নত দেশের দিকে আগ্রহ তত বাড়বে, ফলে হবে মেধা পাচার। সর্বোপরি আমাদের গুরুজনেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মানের দিকে গুরুত্বারোপ করবেন, এটাই প্রত্যাশা।

মোহাম্মদ হাছান
শিক্ষার্থী
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়