এই সিজিপিএ দিয়ে আমার কী হবে?

Galib Mujahid

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান হওয়া চাই সৃজনশীল ও উদ্ভাবনধর্মী, যা শিক্ষার্থীর লুকায়িত শক্তিকে জাগ্রত করতে পারবে; আবিষ্কার করতে পারবে তার মনোজগৎকে। তার জন্য লাইব্রেরি হতে পারে মূল সহায়ক, যা স্বয়ংশিখন ও জ্ঞানের জন্য একটি আলোকিত স্থান হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরিতে তাঁদের উপযোগী বিভিন্ন বই পড়ে নিজেদের অন্তর্জগৎকে করতে পারেন সমৃদ্ধ। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কি শিক্ষার্থীদের সেই সুযোগ দেয়? নাকি দিলেও শিক্ষার্থীরা নিতে ব্যর্থ হয়?

বর্তমানে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা গতানুগতিক চোথা (শিট) মুখস্থ করা ও পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের স্লাইড বা লেকচারনির্ভর। শিক্ষকেরা তাঁদের তৈরি করা স্লাইড অথবা ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করা স্লাইডগুলো বছরের পর বছরে পেরিয়ে গেলেও পরিবর্তন করছেন না; সময়ের সঙ্গে নিজেদের অনুবর্তী জ্ঞানকে জাগ্রত করছেন না। কারণ, তাঁদের কেউ শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে চাপ দিচ্ছেন না। বছরের পর বছর একই জিনিস নিজেদের মতো করে পড়িয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।

শিক্ষকের দেওয়া শিক্ষা উপকরণ, লেকচার শিট ও অন্যান্য জিনিস সংগ্রহ করে মুখস্থ করতে পারলেই যেন বিদ্যার জাহাজ হওয়া যায়। ভালো সিজিপিএও পাওয়া যায়। শিক্ষকেরা তাঁদের শিট থেকে হুবহু প্রশ্ন পরীক্ষায় দিয়ে দিচ্ছেন। ফলে ভালো সিজিপিএ পেতে হলে সিনিয়রদের কাছ থেকে ওই শিক্ষকের পুরোনো নোট ও স্লাইডগুলো সংগ্রহ করে মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় উগরে দিতে পারলেই হলো! এখন এমন সিজিপিএ দিয়ে কী হবে, যে সিজিপিএ নিজের মগজকে বিকশিত করতে পারে না? পারে না নিজেকে অন্যভাবে আবিষ্কার করতে!

আমাদের দেশে মুখস্থনির্ভর বিদ্যা ছাড়া নিজের পাণ্ডিত্য বা জ্ঞান জাহির করার তেমন সুযোগ নেই। থাকলেও তা যৎসামান্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতে গোনা কিছু শিক্ষক আছেন, যাঁরা শিক্ষার্থীদের মনকে বিকশিত করতে, নতুন কিছু আবিষ্কার করতে সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী পথ বেছে নেন। তাঁরা শুধু শিক্ষার্থীদের গবেষণাবান্ধব পড়ানই না, বরং পাঠক্রম পরিচালনা ও উৎসাহ প্রদান করেন। কিন্তু উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল পরিবেশ কি আমাদের আছে? এই খাতে যেমন রয়েছে বাজেটের অপ্রতুলতা, তেমন রয়েছে না শেখার প্রতিকূলতা।

আমরা সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী কিছু শিখতে গেলে আমাদের মনকে যেন দুর্বিষহ যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। আমরা আগে থেকে প্রস্তুত মকরা খাবার খেতে বোধ হয় বেশি পছন্দ করি। কিন্তু তৈরি করে খাবার খেতে গেলে যেন জগাখিচুড়ি লেগে যায়।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা হওয়া উচিত এমন, যেখানে আমাদের গবেষণার পেছনে ছুটতে বলবে; শিটের পেছনে ছুটতে পথরোধ করবে। বিভিন্ন কোর্স–সম্পর্কিতক বই পড়া, জার্নাল ও আর্টিকেল পড়ার জন্য অনুপ্রাণিত করবে। কোনো বিষয়ে আর্টিকেল পড়া যেন আমাদের একপ্রকার বিলাসিতা। কারণ, তা পরীক্ষার ফলাফলে প্রভাব ফেলবে না। তার চেয়ে ফটোকপির দোকানে সিরিয়াল ধরে শিক্ষকের নির্দিষ্ট সীমিত জ্ঞানের শিটের প্রতি মনোযোগ দিতে পারলে ভালো ফলাফল বয়ে আনবে। প্রশংসা কুড়াবে নিজের বন্ধুদের কাছে। কিন্তু চাকরির বাজারে ওই সিজিপিএ কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে? কতটুকু চাকরি পেতে প্রভাব ফেলবে? কতটুকু বিষয়বস্তু শেখার গ্যারান্টি দিতে পারবে?

বাংলাদেশে এমনিতে বিষয়ভিত্তিক চাকরিতে রয়েছে অপ্রতুলতা। ইউজিসির বেঁধে দেওয়া চাকরির শর্তে যত সিজিপিএ প্রয়োজন, তা নিশ্চিত করে এর পাশাপাশি সহশিক্ষা ও চাকরির পড়া পড়লে বোধ হয় মন্দের ভালো হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়
কেউ বুয়েট থেকে ৩.৩০ সিজিপিএ নিয়ে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সুযোগ পান, কেউ আবার অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিজিপিএ ৪ পেয়েও চাকরির বাজারে বা পিএইচডির জন্য নিজেকে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন।

ব্যক্তিগত জীবনে সফল হতে গেলে অনেকগুলো প্যারামিটার কাজ করে, তার মধ্যে একটি হলো সিজিপিএ। অবশ্যই ভালো সিজিপিএ ভালো সংকেত নির্দেশ করে। কিন্তু মুখস্থনির্ভর হয়ে, জানার অগভীরে ডুব দিয়ে সিজিপিএ অর্জন করলেও সফলতার নিশ্চয়তা মিলবে না। তার চেয়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে এসে মুখস্থনির্ভর সিজিপিএ অর্জন করার চেয়ে শেখাবান্ধব ও উদ্বোধনী পরিবেশ তৈরিতে তথাপি যোগ্য হয়ে উঠতে পারলে হা-হুতাশ করতে হবে না; চাকরি নিয়ে উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠিত হতে হবে না। তাহলে অনুশোচনা নিয়ে বলতে হবে না যে এই সিজিপিএ দিয়ে আমার কী হবে?

রাসেল হোসেন সাকিব

শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়