বিস্ফোরণ: সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা জরুরি

রাজধানীতে সম্প্রতি এক বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন
ছবি: সংগৃহীত

ঘরে বা বাইরে আমরা যেন প্রতিনিয়ত বোমার সঙ্গে বসবাস করছি। শয়নকক্ষে লাগানো শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, বাসাবাড়িতে গ্যাসের সিলিন্ডার বা লাইন, সেপটিক ট্যাংক, রাসায়নিক গুদাম, গাড়ির সিলিন্ডার, কারখানার বয়লার যেন একেকটি এক প্রকার মারণাস্ত্র ও চলন্ত বোমা। বর্তমানে মনে হচ্ছে বিস্ফোরণ শব্দটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক বিভীষিকা শেষ হতে না হতেই অপর বিভীষিকাময় বিস্ফোরণ ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলছে পুরো দেশকে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের এক বছর পার হতে না হতেই সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট, ঢাকার সায়েন্স ল্যাব এলাকা ও গুলিস্থানে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল।

পত্রিকার পাতা বা টেলিভিশনের পর্দাতে চোখ রাখলে আমরা প্রতিদিনই এমন অগণিত ছোট-বড় বিস্ফোরণের খবর দেখতে পাচ্ছি। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর ঢাকা শহরে তিন হাজারের বেশি আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় দশটি আগুন লাগার ঘটনা ঘটে রাজধানীতে। এসব অগ্নিকাণ্ডের কোনটিতে জ্বালানি গ্যাস, এলপিজি অথবা রাসায়নিক গুদামের দাহ্য কেমিক্যাল যুক্ত হওয়ায় আগুন ভয়াবহ বিস্ফোরণে রূপান্তরিত হচ্ছে। ঢাকা শহরে, বিশেষত পুরান ঢাকায় ও বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রামে অসংখ্য রাসায়নিক গুদাম রয়েছে। ২০১০ সালের জুনে পুরান ঢাকার নিমতলিতে ও ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে চকবাজারের চুড়িহাট্টাতে রাসায়নিক গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এরপর সরকার জনবসতিপূর্ণ এলাকা হতে দূরে রাসায়নিক পল্লি স্থাপন করার জন্য জায়গা ঠিক করেছিল, গ্রহণ করা হয়েছিল বিভিন্ন প্রকল্প, নেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন উদ্যোগ। কিন্তু ধীরগতির কারণে কাজ এখনো শেষ হয়নি। যার ফলে এসব ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোয় এখনো হাজারো রাসায়নিক গুদাম রয়ে গেছে। যেকোনো সময় আবারও ঘটতে পারে ভয়ানক দুর্ঘটনা। রাসায়নিকের কারণে অগ্নিকাণ্ড বা বিস্ফোরণ হলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যে কারণে নিরাপদ রাসায়নিক ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় বিধিমালা থাকা প্রয়োজন। এর আওতায় দেশে রাসায়নিকের তালিকা, মোট পরিমাণ ও অবস্থানের একটি তথ্য ভান্ডার তৈরি প্রয়োজন, যা রাসায়নিক নিরাপত্তা প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। রাসায়নিক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকারের ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর (যেমন বিস্ফোরক অধিদপ্তর, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, পরিবেশ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী) পাশাপাশি এই খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করতে হবে।

গ্যাসের বিস্ফোরণে মৃত্যুর মিছিল আমাদের দেশের প্রথা হয়ে গেছে এবং আমরা এর পেছনে দোষী খোঁজার জন্য ব্যস্ত হয়ে যাই কিন্তু এর প্রতিকার নিয়ে চিন্তা করি না। চিন্তা করলেও সেটা বাস্তবে রূপলাভ করে না। বরং খাতা–কলমে সীমাবদ্ধ থেকে যায়। প্রতিবার দুর্ঘটনার পর কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তারপর তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন দাখিল করে, যার বেশির ভাগটিতে ভবন মালিককে দোষী করা হয়। এরপরের কার্যক্রম আর আলোর মুখ দেখে না। তাই এ সমস্যা হ্রাস করার জন্য দ্রুত ও সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে এবং তদন্তে দোষীদের যথাযথ বিচারপূর্বক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

২০২১ সালের ২৭ জুন ঢাকার মগবাজারে গ্যাস হতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছিল। জানা যায়, তিনতলা ভবনের নিচতলাতে জমে থাকা গ্যাস হতে বিস্ফোরণ ঘটেছিল। ৫ মার্চ ঢাকার সায়েন্স ল্যাব এলাকার একটি তিনতলা ভবনে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ৩ জন নিহত হয়েছেন এবং ১৪ জন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন, যাঁদের অনেকের অবস্থা সংকটাপন্ন। সায়েন্স ল্যাবের এ বিস্ফোরণটি মগবাজারের বিস্ফোরণের অনুরূপ। আমরা মগবাজারের বিস্ফোরণের পর সতর্ক হলে হয়তো সায়েন্স ল্যাবের দুর্ঘটনাটি না–ও ঘটতে পারত। আমাদের দেশে বাসাবাড়িতে সব সময় গ্যাস সংযোগের লাইনে গ্যাস সরবরাহ থাকে না। যে কারণে অনেকে চুলা জ্বালিয়ে রাখেন, যার ফলে লাইনে গ্যাসের সরবরাহ এলে রান্নাঘরে গ্যাস জমে যেতে পারে। গ্যাস লাইনের রাইজারে (গ্যাস সরবরাহের সংযোগস্থল) অনেক সময় লিকেজ থাকে এবং সেখান দিয়ে গ্যাস বের হয়।

আমাদের দেশে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ নেওয়ার একটি প্রচলন রয়েছে। অবৈধভাবে এই সংযোগ নেওয়ার সময় অনেকে সরবরাহ করা লাইনে ছিদ্র করে ফেলেন, যার ফলে ছিদ্র হতে গ্যাস বের হয়। অনেক দিন যাবৎ ঘরের দরজা জানালা বন্ধ থাকলে, জমে যাওয়া এ গ্যাস আগুনের ছোট্ট একটি স্ফুলিঙ্গ পেলেই বোমার মতো বিস্ফোরিত হয়ে ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। ১৯৩৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের একটি স্কুলে গ্যাস বিস্ফোরণে প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যুর পর গ্যাসে গন্ধ মেশানোর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। তারপর বিশ্বের সব উন্নত দেশ সরবরাহ করা গ্যাসে গন্ধ মেশানোর বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করে। আমাদের দেশেও এখনই পাইপের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের যথাযথ স্থানে এবং সিএনজি, এলপিজি, গ্যাসের সিলিন্ডারে ভরার আগেই গন্ধযুক্ত রাসায়নিক মেশানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া বিস্ফোরণজনিত আঘাতে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি এড়াতে সাধারণ মানুষের করণীয় সবচেয়ে বেশি। অবহেলা, অসচেতনতা ও সতর্ক না হওয়ার কারণেই আবদ্ধ কক্ষে জমাটবদ্ধ গ্যাস থেকেই বিস্ফোরণ বেশি ঘটে। এ ছাড়া বসতবাড়ি বা অফিসে এসি বিস্ফোরণ ও ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। দেশে আবাসিক ও অনাবাসিক উভয় স্থানেই আমরা অগ্নিকাণ্ড বা বিস্ফোরণ ঘটতে দেখেছি। অধিকাংশ বহুতল ভবনে অগ্নিনির্বাপণের মহড়া হয় না, অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র থাকলেও সেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ ও ব্যবহারের অনুপযোগী। অনেক ভবনে আবার ফায়ার এক্সিট নেই। গৃহসজ্জার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করা হয়। আমাদের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বাহিনীর বহরে অগ্নিনির্বাপণের জন্য আধুনিক এবং পর্যাপ্ত সামগ্রী নেই। যার ফলে অগ্নি নির্বাপণের জন্য এখনো আমাদেরকে সনাতন পদ্ধতির ওপর নির্ভর করতে হয়। এতে অগ্নিনির্বাপণ করতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের অনেক কর্মী আহত ও নিহত হচ্ছেন। পাশাপাশি অগ্নিকাণ্ডে বা বিস্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কমানো যাচ্ছে না। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোর অগ্নিকাণ্ডে ফায়ার সার্ভিসের ১০ কর্মীসহ মোট ৬৭ জন নিহত হয়।

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদেরও আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ সামগ্রীর ব্যবস্থা করতে হবে। এসির বিস্ফোরণ হ্রাসের জন্য আমাদের কিছু করণীয় রয়েছে, সেগুলো হলো দীর্ঘদিন এসি বন্ধ থাকলে চালু করার আগে পরীক্ষা করে নিতে হবে। নিজেরা ব্যর্থ হলে দক্ষ টেকনিশিয়ানের সাহায্য নিতে পারি। নিয়মিত গ্যাস চেক করতে হবে। ভালো মানের কম্প্রেসর, রেফ্রিজারেটর ও সার্কিট ব্রেকার ব্যবহার করতে হবে। এসি হতে কোনো গন্ধ বা শব্দ হলে সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দিতে হবে। দীর্ঘ সময় একটানা এসি চালানো পরিহার করা, এসি কেনার আগে তার মান যাচাই করে নেওয়া উচিত—এসব বিষয়ে সচেতন থাকলে এসি বিস্ফোরণের পরিমাণ শূন্যে নিয়ে আসা সম্ভব। সরকারি সংস্থাগুলোয় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। যার ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে একপ্রকার হযবরল অবস্থা দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে এ সমস্যা থেকে উত্তরণের কোনো প্রচেষ্টা আমরা দেখতে পাই না। দুর্ঘটনা এড়াতে সবার সচেতনতা, সতর্কতার পাশাপাশি তদারক সংস্থাগুলোর তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের আত্মসচেতন হতে হবে। সেপটিক ট্যাংক, এসি, গ্যাসের লাইন, গাড়ি ও বাসার সিএনজি সিলিন্ডার, কারখানার বয়লার ও রাসায়নিক গুদামের ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের আরও মনোযোগী হতে হবে। কারণ, এক মুহূর্তের অসতর্কতায় ঘটে যেতে পারে ভয়ংকর বিস্ফোরণ, ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে কোটি কোটি টাকার সম্পদ, বাড়তে পারে মৃত্যুর মিছিল। তাই সাবধানতা অবলম্বন করা অতীব জরুরি। আসুন নিজেদেরকে আত্মসচেতন করি, বিস্ফোরণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি—এই হোক আমাদের প্রত্যয়।

মো: নাইমুর রহমান শাওন
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: [email protected]